জীবন-মৃত্যুর বিস্ময় ভাবনা: কবি কে জি মোস্তফা - দৈনিকশিক্ষা

জীবন-মৃত্যুর বিস্ময় ভাবনা: কবি কে জি মোস্তফা

আহমদ রফিক |

ভাবুক মাত্রই জীবন-মৃত্যুর বিস্ময় নিয়ে অভিভূত, বিমূঢ়ও বটে। তিনি কবি হতে পারেন, নাও পারেন। জানি না আধুনিক প্রজন্ম ভাবুকতার কতোটা মূল্য দেয় বা আদৌ দেয় কিনা। কিন্তু মননশীলতা ভাবনাকে টানে। শিক্ষা তার সহায়ক শক্তি। সর্বজনের শিক্ষা তাই এতটা গুরুত্বপূর্ণ।

এখন যাদের বয়স ষাট বা সত্তরেরও বেশি, তাদের মধ্যে প্রায়শই দেখি গ্রাম ও ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে ‘নস্টালজিয়া’। গ্রামের রূপময় প্রকৃতি নিয়ে অভিভূত কথাবার্তা বা লেখাজোখা। কবি, গীতিকার কেজি মোস্তফাই বা ব্যতিক্রম হবেন কেন? তার লেখা স্মৃতিকথা যা ‘জীবননামা’রই আরেক বয়ান, রীতিমত আকর্ষণীয়।

আমার বিশ্বাস. ভাবুকতার সঙ্গে একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার বোধহয় গূঢ় সম্পর্ক আছে। বহুজনসংশ্লিষ্ট হয়েও কোনো কোনো মানুষ নিজের মধ্যে একা; একাকিত্বের স্বাদ নিতে নিতে ভাবুকতায় মগ্ন। বিশেষ করে পরিবেশ প্রভাবে। এমন সব মানুষ স্মৃতি হাতড়াতে গেলে অনেক কিছুর ফাঁকে, বাস্তবতার গ্রানাইট চত্বর পার হতে হতে কখন যে জীবন- মৃত্যুর রহস্যময় ভাববাদিতায় জড়িয়ে পড়েন, তা বুঝি তিনি নিজেও জানেন না। 

অবশ্য এর কারণও আছে। বিশ্বসৃষ্টি, জীবনের আবির্ভাব ও অনিবার্য মৃত্যুর অন্তহীন সময়ে ডুবে যাওয়া সত্যিই এক অপার বিস্ময়। যার কূল-কিনারা এখনও বিজ্ঞানীর হাতে ধরা দেয়নি। তাই ভাবুক বা কবি, বস্তুবাদী বিজ্ঞানী বা বিমূর্ত চিন্তার দার্শনিক ওই বিষয় তিনটির রহস্যভেদে অস্থির।
সেই কবে মধ্যযুগে ওমর খৈয়াম, যাঁর খ্যাতি কবি-বিজ্ঞানী-দার্শনিক হিসাবে, পূর্বোক্ত মৌল প্রশ্নগুলো তুলে ধরেছিলেন তাঁর লেখা ‘রুবাই’ অর্থাৎ চতুষ্পদী কবিতায়। অত্যাধুনিক বিজ্ঞানী বা দার্শনিক এখনো যেসব প্রশ্ন নিয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। এখনতক দেখা পাননি অন্বিষ্টের। 

নিকটজন কে জি মোস্তফার ‘কোথায় চলেছি আমি’ শীর্ষক স্মৃতিকথা বা জীবননামা পড়তে পড়তে তার লেখার সূত্র ধরেই কথাগুলো মনে এল। যে প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি, ভাবুকতার টানে কবি বা ভাবুককে সেখানে পৌঁছাতেই হবে। পেতে হবে উত্তর।  

তাঁর ভাষায় ‘কোথায় চলেছি আমি’! মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি যেন এক প্রবাসী পান্থ। যেতে হবে কতদূর আরও (কত) দূর জানি না’...। এমন ভাবনা খৈয়াম থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং একালের কে জি মোস্তফা কম বেশি সবার। সে সঙ্গে প্রিয় পৃথিবীকে ছেড়ে যাওয়ার অনিবার্য প্রসঙ্গ নিয়ে বিষণ্নতা। এটা সর্বজনীন চরিত্রের। সে বিষণ্নতার সূত্রে সান্ত্বনা রূপে গড়ে উঠেছে জন্মান্তর তত্ত্ব। তাতেও আশ মেটে না। কারণ জন্মান্তরের প্রমাণ হাতে মেলেনি।                            

কবি, গীতিকার কে জি মোস্তফা বিশ^মানের ‘বিশৃংখলা’কে মেনে নিয়েই প্রাকৃত সৌন্দর্য আর জীবনের প্রতি ভালবাসাকে যেন নিয়তিসম বলে মেনে নেন। সাজাতে থাকেন শব্দের সুশৃংখল বিন্যাস। ‘ভালোবাসা’ শব্দটি নিয়ে প্রগলভ ছিলেন কবি গীতিকার রবীন্দ্রনাথ। সে শব্দটির গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর আর্জেন্টিনাবাসী অনুরাগিনী ভিক্টোরিয়া ও’ ক্যাম্পো।

আর জীবন-মৃত্যুও মহাবিশে^র বিস্ময়? এসব নিয়ে যে সংশয়ের তীর পদার্থবিজ্ঞানী জিন্স থেকে আইনস্টাইন এবং একাধিক বিজ্ঞানীর গভীর ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তার কিছু উল্লেখ করেছেন কে জি মোস্তফা তাঁর লেখার শেষ পর্বে পৌঁছে। করারই কথা। প্রশ্নটি তো শাশ^ত চরিত্রের। 

পদার্থবিজ্ঞানী বা নভোবিজ্ঞানী মাত্রেই তাঁদের ভাবনার আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে শেষ জবাব পেতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। তবু নানা মুনির নানা মত। এমনটাই পাণ্ডিত্য বা বৈদগ্ধ্যের ধর্ম। তারা পরস্পরবিরোধী কথা বলবেন বা তত্ত্ব উপস্থাপন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। 

স্বনামখ্যাত সময়-বিজ্ঞানী হকিং একসময় আস্তিক্যবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলার পর সম্প্রতি বেশ জোর গলায় মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মহাবিশ^ বা রহস্যময় সৃষ্টিকে তিনি ‘স্বয়ম্ভু’ মনে করেন। কে জানে এ বিষয়ে আবার তার মত পরিবর্তন হবে কিনা। তবে এসব জটিল বিষয় নিয়ে সংশয়বাদকে অনেকটা নিরাপদ অবস্থান বলে কেউ কেউ মনে করেন। অর্থাৎ না এধার, না ওধার। 

সেসব তর্ক বা বিতর্ক আপাতত দূরে থাকুক। সব শেষে একটি কথাই জানাতে চাই: কে জি মোস্তফার পকেট সাইজের চেহারা ‘কোথায় চলেছি আমি’ এমন সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ ভাষায় লেখা, যা ভাষা ও বিষয় বৈগুণ্যে সুখপাঠ্য। অন্তত আমার কাছে। 
কবিকে শেষ বাক্যে বলতে হয়: কোথাও চলে যাবার ইচ্ছা না থাকলেও রূপময়ীকে ছেড়ে যেতে হয়। ঠিকানাবিহীন সে যাত্রা অন্তহীন সময়ের হাত ধরে চলে। আর এটাই মানব জনমের চরম ট্রাজেডি। তাই কারো কারো ক্ষুব্ধ প্রকাশ: ‘কী হতো তাৎক্ষণিক আবাস এ পৃথিবীতে না এলে? তবু অন্য কারো মন্তব্য : এসে যা পেয়েছি, যা দেখেছি, তাই বা কম কীসে।’ 
কবি-বন্ধু কে জি মোস্তফা এমন সব মূর্ত বিমূর্ত ধারণায় দোলায়িত। মূলত তাঁর গীতিকার-কবি চরিত্রের কারণে। সেখানে জীবন-মৃত্যুর ভাবনায়ও নিহিত অতৃপ্তি, নানান প্রশ্ন, যেসব প্রশ্নের উত্তর কবে মিলবে, আদৌ মিলবে কিনা সেটাই বড় বিবেচ্য।

তার জীবননামা ‘কোথায় চলেছি আমি’ পাঠকপ্রিয় হবে এমনটিই আমার প্রত্যাশা।  
                        

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক, রবীন্দ্র-গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ - dainik shiksha শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066390037536621