জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের ভুল প্রসঙ্গে - দৈনিকশিক্ষা

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের ভুল প্রসঙ্গে

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

একটা চিরন্তন সত্য প্রবাদ দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করছি। ‘মানুষ মাত্র ভুল হয়, ভুল হয় না শয়তানের’। মানুষ শব্দটির সাথে ‘হুশ’ শব্দটির সম্পর্ক আছে। আমরা যখন কিঞ্চিত হুশ হারিয়ে ফেলি, তখন ছোটখাটো ভুল হয়। আর যখন বেহুশ হয়ে পড়ি তখন বড় ধরনের ভুল হয়। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ বেমালুম ভুলে যান, তারা ছোট্ট সোনামনিদের শিক্ষার কাজে জড়িত। শিক্ষাদানই তাদের একমাত্র মুখ্য কাজ। তারা মাঝে মাঝে কর্মকর্তা, ম্যানেজিং কমিটি, রাজনৈতিক নেতাদেরকে তেল মেরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দূরে থেকে নিজেদের ধন্য মনে করছেন। সংশ্লিষ্টরা তেলে তেলে আবেগাপ্লুত হয়ে তাদের কাছে টেনে নেয়। একটি বার জিজ্ঞেস করে না, আপনি যে আমাকে বিদ্যালয় চলাকালীন তেল মেরে আসছেন, আপনার শিশুর গায়ে তেল মাখাবে কে?

সরকারি কর্মচারীর অহমিকা নিয়ে কতিপয় প্রাথমিক শিক্ষক শিশুশিক্ষার্থীর ক্ষতি করে চলেছে। নেতা নাম খাতায় লেখাতে পারলে তো কথাই নেই। তখন বিদ্যালয়ের পরিবর্তে উপজেলা, জেলা, মহাপরিচালক ও মন্ত্রণালয়ে অবস্থান তাদের জন্য অনেকটা সাত খুন মাফের মতো। যে সব নেতারা শিশুদের ভালোবাসার পরিবর্তে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করে তারা নেতা নামের কলঙ্ক।

সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড নিয়ে সাধারণ শিক্ষকেরা পিটিআইগুলোতে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন, অথচ নেতারা নীরব। মনে হয় সংশ্লিষ্টরা তাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। নানা স্থানে শিক্ষকদের বড় ধরনের অসুবিধা হলে, যেমন চাঁদপুরে শিক্ষক হত্যাকাণ্ডে সাধারণ শিক্ষকেরা উপজেলায় মানববন্ধনসহ তীব্র প্রতিবাদ করেছে, ঝিনাইদহের শিক্ষক নার্গিস সুলতানা ছবি বরখাস্তে ফেসবুক, দৈনিকশিক্ষা ডটকমসহ প্রিন্ট মিডিয়ায় শিক্ষকেরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। তাৎক্ষণিকভাবে জনৈক সিদ্দিক উল্যা নামে এক অ্যাডভোকেট হাইকোর্টে রিটের প্রস্তুতিও নিচ্ছিল।

মহাপরিচালক মহোদয় বরখাস্তের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এ সময়ে প্রাথমিকের নেতাদের গর্জনের পরিবর্তে এমন ভাব দেখা গেল যেন, মাফ করে দাও ওহে প্রভু, আমরা এসেছি তোমার কাছে একজন অপরাধীর পক্ষ থেকে মাফ চাইতে। হায়রে নেতৃত্ব! প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে আজ নেতৃত্ব কোথায় দাঁড়িয়েছে। 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ঝিনাইদহে সাময়িক বরখাস্তের আদেশে ২২টি বানান ভুল প্রসঙ্গে আমার মতামতটা সম্পূর্ণ আলাদা। বাস্তবে এ ভুল আমার মতো সিনিয়র শিক্ষকদের। যারা তাকে ভালোভাবে শুদ্ধ বানান শেখায়নি। পাশাপাশি আরও দায়ী হলো সংশ্লিষ্টরা, যারা তাকে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

আমাদের শিক্ষক বা অভিভাবকেরা প্রায়ই দোষারোপ করে থাকেন, আজকাল ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে না। শিক্ষকেরাও এই শিখে না শব্দ বলে তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতা ঢেকে থাকেন, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবাদের মতো। প্রাথমিক শিক্ষা সংকটে জর্জরিত। যেমন শিক্ষক সংকট, বহুমুখী কাজে শিক্ষকদের ব্যস্ত রাখা, ১১ ধরনের কমিটিসহ বহু লোকের মন জুগিয়ে চলা।

গরীব মানুষের সন্তানেরা পারিবারিক কাজে মা-বাবাকে সময় দিতে হয়। এতে তারা প্রায়ই বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। বিদ্যালয়ের বিশাল কর্মঘণ্টা তাদের অনুপস্থিত থাকার মূখ্য কারণ। বেশিরভাগ পরিবারের অভিভাবকের শিক্ষার্থীর পড়াশোনা দেখভাল করার সুযোগ বা যোগ্যতা নেই। বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সমাপনীর বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সংস্পর্শ ছেড়ে চলে যান উপজেলা শিক্ষা অফিসে। এককথায় শিক্ষকদের সারা বছরই অনেকটা দৌড়ের ওপর থাকতে হয়।

শিক্ষার্থীদের ইংরেজি-বাংলা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন, নিঃসন্দেহে সচিব মহোদয়ের মহতী উদ্যোগ। প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে বেসরকারি বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়সমূহের ভ্রান্ত পাঠদান সম্পর্কে জনমনে ধারণা দিতে হবে। সচিব, প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১ম-৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তার মানে এই নয় যে, শুধু সরকারি প্রাথমিকে এটা কার্যকর হবে। এ নির্দেশনা বাংলাদেশের সকল শিশুর জন্য, যারা ১ম-৩য় শ্রেণিতে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সকল শিশুর জন্য শিশুবান্ধব কর্মঘণ্টা, বই, মূল্যায়ন পদ্ধতি একই করা দরকার। এতে অর্থ ব্যয় হবে না, বরং শিশুশিক্ষা ফলপ্রসু হবে।

বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন করার বিরুদ্ধে সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করছে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ। সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়াজউদ্দিন মহোদয় দায়িত্বে এসে প্রতিনিয়ত বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত করতেন। এ ধারা আজও অব্যাহত আছে। এ বরখাস্ত বেআইনি। শোডাউন বা নিজের অবস্থান জানানোর জন্য সরকারি কর্মকর্তারা বেহুশ হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অহরহ এ কাজটি করে যাচ্ছেন।

প্রাথমিক শিক্ষকদের সকল ধরনের গাফিলতির বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক শাস্তি দিতে হবে। বিলম্বে উপস্থিত, অনুপস্থিত, কর্তব্য কাজে অবহেলা সকল বিষয়ে যথাযথ শাস্তির বিধান আছে। এখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকসহ সকলকে রুখে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষক অন্যায় করবে তার শাস্তি হবে না, তা কাম্য নয়। সংশ্লিষ্টরা প্রভু সেজে অন্যায় করবে, আমাদের শিক্ষক নেতারা ‘জ্বি হুজুর, জ্বি স্যার’ বলে তেল মারবে তাও মেনে নেয়ার মতো না।

ঝিনাইদহের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের অন্যতম ত্রুটি হলো সরকারি কর্মচারীর বিধি জেনেও তা অমান্য করা। আইনের প্রতি যত্নশীল হওয়া, আইন মেনে চলা প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীর কর্তব্য। ঝিনাইদহের শিক্ষক নার্গিস সুলতানার যদি শিক্ষকতায় কর্তব্যে গাফিলতি হয়ে থাকে তবে তার জন্য বিধি মোতাবেক শাস্তি হোক। যদি কেউ বিধি বহির্ভূত শাস্তি দিয়ে থাকেন তারও শাস্তি হোক। নিয়মের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে চলুক সেই প্রত্যাশা রইল। 

লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিকশিক্ষা ডটকম।

নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.019016027450562