জোরপূর্বক শিক্ষাদান করার চেষ্টা করা তো শিক্ষাদান নয় - দৈনিকশিক্ষা

জোরপূর্বক শিক্ষাদান করার চেষ্টা করা তো শিক্ষাদান নয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মারকাযুল কুরআন ইসলামিক একাডেমি মাদরাসার আট বছর বয়সি এক আবাসিক ছাত্রকে জন্মদিনে তার মা দেখতে গিয়েছিলেন। বিদায়ের সময় শিশুটি মায়ের পেছন পেছন যেতে শুরু করে। বাবা-মা থেকে দূরে থাকা ওই বয়সের বাচ্চাদের যা করার কথা শিশুটি তাই করেছিল। কিন্তু এই ঘটনাকে অপরাধ ধরে নিয়ে তাকে ওই মাদরাসার এক শিক্ষক প্রথমে ঘাড় ধরে মাদরাসার ভেতর নিয়ে যান। কয়েক পা যাওয়ার পর শিশুটিকে একটি ঘরে ঢোকানো হয়। এরপর শিশুটিকে মাটিতে ফেলে বেত দিয়ে নৃশংসভাবে পেটাতে শুরু করেন। শুরুতে শিশুটির ডান হাত ধরে পেটানো হয়। একপর্যায়ে শিশুটি মাটিতে শুয়ে পড়ে। তখন তার ডান পা টেনে ধরে পায়ের ওপর পেটাতে থাকেন ওই শিক্ষক। তারপর পা ধরে সারা শরীরে বেত দিয়ে বেদম প্রহার করেন। শনিবার (১৩ মার্চ) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আট বছরের শিক্ষার্থীকে প্রহারের ৩৩ সেকেন্ডের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় ওঠে। এই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে হাটাহাজারীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিশুটিকে মাদরাসা থেকে নিয়ে আসেন। আটক করা হয় শিক্ষককেও, কিন্তু শিশুটির মা-বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে রাজি না হওয়ায় প্রশাসন একপর্যায়ে শিক্ষককে ছেড়ে দেয়। অবশ্য মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এ শিক্ষককে আপাতত বহিষ্কার করেছে। ফেসবুক খুললে প্রায়ই দেখি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চলছে। পুরোটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। কারণ যারা ধর্ম-কর্ম পালন করেন এবং ধর্মীয় শিক্ষাদান করেন তাদের হৃদয় কোমল ও মায়ায় ভর্তি থাকার কথা। সেই হিসেবে কোনো মহলের কারসাজিতেও এটি হতে পারে। কিন্তু ঘটনা তা নয়। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও মিডিয়ায়ও প্রকাশ হতে দেখি।

শিক্ষাদান যে কী ধরনের পরিবেশে, কী আচরণ নিয়ে করতে হয় সে নিয়ে দেশে-বিদেশে নিরন্তর গবেষণা চলছে, চলছে প্রশিক্ষণ, আইন প্রণয়ন, সচেতনতা কার্যক্রম ইত্যাদি। কিন্তু মাদরাসা পর্যায়ে বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সরকার ২০১১ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে। আমাকে এখনো অনেক শিক্ষক জিজ্ঞেস করেন, স্যার বিষয়টি কি ঠিক হয়েছে? আবার কেউ কেউ ফেসবুকে লিখেছেন, বিদ্যালয় থেকে বেত উঠে গেছে বলে শিক্ষার্থীদের বেয়াদবির মাত্রাও দিন দিন বেড়ে গেছে। কেউ কেউ ফেসবুকে লেখেন বিদ্যালয়ে বেত নেই, তাই বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলাও নেই। এ কথাগুলোর পেছনের কারণগুলো হচ্ছে যুগ যুগ ধরে শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে শিক্ষাদান চলে এসেছে। গুরুর ‘মার’ না খেলে শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত হয় না। দ্বিতীয়ত, শিশু মনোবিজ্ঞানের ধারণা শিক্ষকদের দেয়া হয় না, কেউ কেউ হয়তো নিজেরা কিছুটা ধারণা সংগ্রহ করেন।

বাকিরা জানেন না যে, শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করবেন। শিক্ষার্থীরা চঞ্চল থাকবে, অনুকরণ করবে, কয়েক মিনিট খালি বসে থাকবে না, সমবয়সিদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গল্প করবে, তারা অত্যন্ত চতুর ও তীক্ষè। শিক্ষক থেকে শুরু করে কারোর কোনো ধরনের ব্যতিক্রম চোখে পড়লে সেটি নিয়ে আলোচনা করবে, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে, গল্পের বিষয় হিসেবে সেটিকে নেবে। যে বিষয়ে তারা মজা পাবে না সেটি তারা জানতে বা পড়তে চাবে না। আমাদের অনেক শিক্ষক মনে করেন যে, বিষয় পড়ালেই শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হবে এবং শ্রেণিকক্ষে সুবোধ বালকটির মতো তারা বসে বসে শিক্ষকের সব কথা শুনবে। যারা তা করবে না তারাই বেয়াদব, তারাই উচ্ছৃঙ্খল। আসলে বিষয়টি তা নয়। যেসব শিক্ষক এসব বিষয়ে লক্ষ্য করে শিক্ষার্থীদের পাঠকে আকর্ষণীয় করতে পারেন, তাদের সাইকোলজি বুঝে পাঠদান করতে পারেন তারা সফল হন। শিক্ষকতা পেশা তাদের কাছে আনন্দের মনে হয়। বাকিদের কাছে নিতান্তই সমস্যাসংকুল এক পরিবেশ মনে হয়। দেশের সব শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব ধারণা দেয়া, প্রশিক্ষণ দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের মতো দেশে এটি এখনো সম্ভব হয়নি। এক, অর্থনৈতিক কারণ দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ। তবে ধীরে ধীরে উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে।

মাদরাসায় কী হয়? এখানে সাধারণত অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের পাঠানো হয়। অভিভাবকরা একদিকে অসচেতন, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তার ওপর ধর্মীয় বিশ^াস এভাবে তারা ধারণ করেন যে, শিক্ষকের শাস্তি না পেলে তাদের সন্তানরা মানুষ হবে না (যদিও সবাই নয়)। সাধারণ শিক্ষকরা দেশে-বিদেশে, স্থানীয় পর্যায়ে, বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনবরত প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। তারপরও তাদের বিশাল সংখ্যকের মধ্যে শিশু বিজ্ঞান এবং সঠিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। তারা এখনো এসব আলোচনা করেন, শাস্তি না থাকলে শিক্ষা হয় না। এর অবশ্য কারণও আছে যে, একজন শিক্ষককে প্রচুর ক্লাস নিতে হয়, প্রস্তুতি নেয়ার সময় থাকে না। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ও জটিলতা তো আছেই। তারপর অনেক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা আদর্শ শ্রেণিকক্ষের ধারণার চেয়ে দুই বা তিনগুণ বেশিÑ এসব কারণে তারা সঠিকভাবে, আনন্দদানের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করতে পারেন না, তাই তারা মনে করেন, শাস্তিদান করলে ক্লাস ঠাণ্ডা থাকে। সেটি যে আসল ট্রিটমেন্ট নয়, এ নিয়ে অনবরত আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কিন্তু কাজ সেভাবে হয়নি। শিশু শিক্ষার্থীদের কীভাবে পড়াতে হবে, কীভাবে তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে এসব বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। দেশে একটিমাত্র মাদরাসা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। সেখানে সবার প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হয় না। তা ছাড়া যারা কওমি মাদরাসায় পড়ে তাদের তো এসব প্রশিক্ষণের কোনো বালাই নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই পেপার-পত্রিকা পড়েন না। ফলে প্রাচীন ধারণা নিয়েই আছেন যে, শারীরিক শাস্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, শিক্ষাদান করতে হবে। জোরপূর্বক শিক্ষাদান করার চেষ্টা করা তো শিক্ষাদান নয়, সেটি তারা বুঝতে চান না।

দেশে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী মাদরাসায় শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার সঠিক তথ্য নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা তা প্রকাশ করে না। যাদের ওপর এ ধরনের ঘটনা ঘটে তারা লজ্জায় ও ভয়ে তা প্রকাশ করে না। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে পত্রিকার সংবাদ থেকে দেখা যায় যে, ৪০ জন শিশু মাদরাসায় বলাৎকারের শিকার হয়েছে। সব তথ্য তো জানাও যায় না। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ২০২০ সালের ৪ মার্চ ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ময়মনসিংহের ভালুকার জামিরদিয়া মাদরাসার ১০ বছরের শিক্ষার্থী তাওহিদুল ইসলাম। পড়া মুখস্থ না হওয়ার অপরাধে ওই মাদরাসার এক শিক্ষক ২৩ ফেব্রুয়ারি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পাঁজরের একটি হাড় ও একটি পা ভেঙে দেন।

ছেলেটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর জয়পুরহাট সদর উপজেলার মুজাহিদপুর নুরানী মাদরাসার এক শিক্ষক চার শিশু শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতন করেন। শিশুদের অভিভাবক বাদী হয়ে জয়পুরহাট সদর থানায় শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করায় ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে তাদের সৃজনশীলতা, উপস্থাপনা উৎসাহিত করতে হবে, কিন্তু বুঝা যাচ্ছে মাদরাসায় বিষয়গুলো অজানা। সাধারণ শিক্ষা যেখানে সমাজ, দেশ, অভিভাবক ও সরকারের প্রচুর মনিটরিং, খোঁজখবর এবং হস্তক্ষেপ আছে তারপরও সব বিষয়ে পরিবর্তন খুব ধীরে ধীরে হচ্ছে। সেখানে মাদরাসায় তো এ ধরনের ঘটনা ঘটার সমূহ-সম্ভাবনা থেকে যায়। আমাদের দেশে মাদরাসা শিক্ষা একটি বাস্তবতা, এটিকে আমরা অবহেলা করতে পারি না, কিন্তু সেখানে যাতে প্রকৃত শিক্ষাদান করা হয়, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজ করে সেটি আমরা অবশ্যই চাইব।

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044469833374023