জোহা স্মরণে শিক্ষক দিবস কেন নয়? - দৈনিকশিক্ষা

জোহা স্মরণে শিক্ষক দিবস কেন নয়?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাঙালি ও বাংলাদেশের ১৮ ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসের সেই দিন, যেদিন এক মহান বাঙালি শিক্ষক বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ এমন মহিমান্বিত কথা পৃথিবীর বুকে কে শুনেছে কবে? ছাত্রছাত্রীদের জীবন বাঁচানোর জন্য শহীদ হওয়া এক যুবক-শিক্ষকের রক্তে রক্তিম হয়েছিল মতিহারের সবুজ ঘাস। বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা নামের সেই মহত্প্রাণ শিক্ষককে কি মনে রেখেছে বাংলাদেশ? মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এ শিক্ষকের আত্মত্যাগের কথা জানবে না দেশের আগামী প্রজন্ম—এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! শহীদ ড. শামসুজ্জোহা একটি নাম, একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস জানার কথা ছিল সমগ্র বাংলাদেশের। সেই ইতিহাস হয়ে রইল শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর সে ইতিহাস স্মরণ করে গেল শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সে গৌরবজনক ইতিহাস বিস্মৃত হচ্ছে বাংলার আপামর জনতা।

আজকের যে শিশু বেড়ে উঠছে স্বাধীন দেশের হাওয়া আর জলে, সেই শিশু কতটা জানতে পারবে কেমন উত্তাল ছিল ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ বিরুদ্ধে বাংলার জনতা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ঊনসত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বাঙালি আত্মদানে নিজেদের উৎসর্গ করার দীক্ষা নিচ্ছিল। উত্তাল বিক্ষোভের মধ্যে ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, যিনি শহীদ আসাদ নামেই সমধিক পরিচিত। এরপর ঊনসত্তরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে।

আসাদ ও জহুরুল হত্যায় দেশের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্র ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শহরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কাজলা গেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সে মিছিলে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। এ সময় ড. জোহা নিজের প্রক্টর পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা তার দাবি মানতে অস্বীকার করলে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন শিক্ষার্থী অন্তঃপ্রাণ মহান বাঙালি শিক্ষক জোহা। বাগিবতণ্ডার এক পর্যায়ে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা তাকে গুলি করে। ড. শামসুজ্জোহাকে গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি পাকি বাহিনী, মতিহারের মাটিকে রক্তরঞ্জিত করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এ মহান শিক্ষককে।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে বর্বররা এই প্রথম কোনো বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হলো ড. শামসুজ্জোহার নাম। তার হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলেনের অনল দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তত্কালীন দেশের শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ আর প্রত্যন্ত প্রান্তরে। জোহার সেই সবুজ চেতনায় কি সজীব হতে পারবে না আমাদের সন্তানরা? রাষ্ট্র এ জাতিকে জোহার চেতনা ও ইতিহাস জানানোর কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? এ কেমন দেশ যারা বীরের সম্মান দিতে পারে না! এ কেমন সরকার যারা জোহার রক্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না!

যে রাষ্ট্র জোহার মতো বীরের স্বীকৃতি জানাতে কুণ্ঠা বোধ করে, সে দেশের জন্য কে জীবন দিতে আগুয়ান হবে? আজ আর দেশের জন্য কেউ জীবন দিতে চায় না। কেউ জীবন দেয় না। সবাই দেশ থেকে নিতে চায়। এ রাষ্ট্র এখন আমাদের লুটেরা হতে শেখায়। চাটুকার হতে শেখায়। দালাল হতে শেখায়। তাই দেশে আজ লুটেরা, চাটুকার আর দালালের জয়জয়কার।

শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে এ রাষ্ট্র তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে এবং তার নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। একুশে পদকও দেয়া হয়নি ড. জোহাকে। এজন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আবেদন জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। পৃথিবীর ইতিহাসে ছাত্রদের জন্য কোনো শিক্ষকের এভাবে জীবন দেয়ার ঘটনা বিরল।

১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে শিক্ষক দিবস ঘোষণার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। সেই আন্দোলনের মিছিলে তিন বছর ধরে যুক্ত হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের আওয়াজ সরকার তো দূরের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও পৌঁছায় না! তা না হলে যেখানে পড়ালেখা করেছেন ড. শামসুজ্জোহা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র-শিক্ষক-সংগঠন কেন এ আন্দোলনে যুক্ত হয় না? প্রত্যেক সরকারের কাছে এ দাবি জানানো হলেও আজ পর্যন্ত কেউ কর্ণপাত করেনি। বর্তমান সরকার নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার বলে দাবি করে। অথচ এ বিষয়ে তাদেরও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

ইউনেস্কো ১৯৯৪ সাল থেকে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করছে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে থাকে। আমাদের পাশের দেশ, ভারত তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরকে সে দেশে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। এমনকি নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকায় পর্যন্ত স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে তাদের শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখায়। বাংলাদেশে ‘হাত ধোয়া’ দিবসের মতো দিবস পালন করা হয় সরকারিভাবে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শিক্ষকদের এত বড় গৌরবজনক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও এ দেশে শিক্ষকদের সম্মান জানানোর কোনো স্বতন্ত্র দিবস নেই।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, কী করে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখাতে শিখবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। বিশ্বের প্রতিটি দেশের শিক্ষক দিবসের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তার মধ্যে বাংলাদেশের একজন শিক্ষকের আত্মদানের ইতিহাস খুবই অনন্য ও মহত্তম। স্বাধীনতার পূর্বক্ষণে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে স্বাধীনতার জন্য চলমান সংগ্রামেই এ আত্মদানের ঘটনাটি ঘটেছে। অথচ ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শিক্ষক দিবস করার জন্য কোনো বুদ্ধিজীবীকেও বলতে দেখা যায় না, লিখতেও দেখা যায় না, এ নিয়ে কোনো দাবি তুলতেও দেখা যায় না। এটা কি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হীনম্মন্যতা নয়?

ড. শামসুজ্জোহার ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরও মফস্বলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করাকে শ্রেয়জ্ঞান করেছিলেন ড. জোহা। রাজশাহীকে ভালোবেসেছিলেন, বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন। ছাত্রদের রক্ষায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাই আমাদের দাবি, মহান এ শিক্ষকের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণা করা হোক ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার দিন ১৮ ফেব্রুয়ারিকে।

লেখক : তোফাজ্জল লিটন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, সাংবাদিক; নাট্যকার।

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034201145172119