জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির বিকাশে গবেষণার মাধ্যম হোক মাতৃভাষা - Dainikshiksha

জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির বিকাশে গবেষণার মাধ্যম হোক মাতৃভাষা

ড. মো. নাছিম আখতার |

মানুষের অবচেতন মনের চিন্তার মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই মাতৃভাষায় বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা অতি দ্রুত কোনো জাতিকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শিল্পনির্ভর হয়ে পড়েছে। শিল্পের বিকাশই কোনো জাতির উন্নয়নের মানদণ্ড। যে জাতি শিল্পে যত উন্নত এবং যাদের উৎপাদিত পণ্য বিশ্ববাজারে যত সমাদৃত, তারাই তত সমৃদ্ধ জাতি। জ্ঞানচর্চার এই যুগে যারা মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরেছে, তারা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ চীনের কথা বলা যেতে পারে।

প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে চীনারা মাতৃভাষাকে ব্যবহার করছে। এর সুফল কিন্তু তারা হাতে হাতে পাচ্ছে। মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার কারণে চীনের ১৫০ কোটি জনগণ তাদের চিন্তা, সৃজনশীলতা, আবিষ্কার সব কিছুতেই সর্বোচ্চ সক্ষমতা সহজভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে চীন আজ পৃথিবীর জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। কারণ ১৫০ কোটি লোকের শতভাগ মেধাশক্তি জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৭৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চীনের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। একই পথ অবলম্বন করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

উন্নত বিশ্বের অন্য দেশগুলোর দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায়, যে জাতিগুলো উন্নত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই নিজেদের মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে সমুন্নত রেখেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়ার মতো বিশ্বের শক্তিধর ও উন্নত দেশগুলো তাদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম মাতৃভাষায় পরিচালিত করে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, রসায়নের পর্যায় সারণির উদ্ভাবক দিমিত্রি মেনডেলিফ তাঁর গবেষণার নিবন্ধগুলো কখনোই ইংরেজিতে প্রকাশ করেননি। সব সময়ই তিনি তাঁর প্রকাশনাগুলো রুশ ভাষায় প্রকাশ করতেন। বিশ্বের অন্যান্য জাতি তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই মেনডেলিফের গবেষণালব্ধ প্রকাশনাগুলো নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছে। যদি মেনডেলিফের ক্ষেত্রে এমন শর্ত থাকত যে ইংরেজিতে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই, তাহলে হয়তো পর্যায় সারণির মতো জটিল একটি বিষয় নিয়ে এমন সুন্দর উদ্ভাবন পৃথিবীর মানুষ দেখতেই পেত না। সম্প্রতি একটি কনফারেন্সে (IEEE) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের চেয়ারপারসনের সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি এক বাক্যে পোল্যান্ড ও রাশিয়ার গণিত পারদর্শিতার কথা স্বীকার করে নেন। এই দুটি দেশই কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা মাতৃভাষাতেই করে থাকে।

ঔপনিবেশিক যুগের চাপিয়ে দেওয়া ইংরেজি শিখতে আমরা এতই গর্ববোধ করি যে আমাদের জাতীয়তাবোধ, দেশাত্মবোধ ও  দেশপ্রেম এর আসুরিক শক্তির নিচে চাপা পড়ে। সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো এক মায়ের উক্তি, ‘আমার ছেলেরা তো বাংলা পড়তেই পারে না এবং পারার চেষ্টাও করে না।’ কথাটি বলার সময় মায়ের চেহারায় আমি যে দ্যুতি দেখেছি তা কখনোই ভোলার নয়। নিজের সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি অবহেলা কোনো ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিজীবনে বা জাতীয় জীবনে মহতী অবদান রাখতে সাহায্য করবে কি না তা ভেবে দেখা দরকার। কোনো সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে গবেষণার মূল বিষয়বস্তু প্রাধান্য না পেয়ে প্রাধান্য পায়  is, am, are বা Preposition-এর সঠিক প্রয়োগের বিষয়টি। তাই শুধু ইংরেজিতে গবেষণাপত্র প্রকাশের বাধ্যবাধকতা দেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীকে গবেষণা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে।

আমি ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করছি না। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম বা ভার্সনে পড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অত্যন্ত কম হওয়ায় দেশের ভেতরে গবেষণা নিবন্ধগুলো মাতৃভাষায়ও প্রকাশ করার সুযোগ থাকা উচিত। এতে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে দেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হবে। এ বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথম প্রস্তাবনাটি আমার মাথায় এসেছে চায়নিজদের সঙ্গে সরকারের বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে কাজ করতে গিয়ে। পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ডাটা সেন্টার তৈরি হচ্ছে কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে।

সেখানে চায়নিজদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার তৈরির টেকনিক্যাল এক্সপার্টরা ইংরেজি জানেন না বললেই চলে। তাদের টিমে একজন ভালো ইংরেজি জানা লোক থাকে। ওই ব্যক্তি ভিনদেশিদের সঙ্গে টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। ফলে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির হিপণ্ড টেকনিক্যাল এক্সপার্টরা ইংরেজি না জেনেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁদের দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। আমাদের দেশের জন্যও এমন উদাহরণ সৃষ্টি করা যেতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ইনোভেশন সেল থাকতে হবে। এই সেলের কাজ হবে প্রতিবছর অন্তত দুইবার সারা দেশ থেকে বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিদের সৃজনশীল চিন্তা ও কর্মকাণ্ড উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া।

এখানে ভাষার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা চলবে না। ইংরেজি বা বাংলা যেকোনো ভাষায়ই গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা যাবে। এর মধ্যে যে কাজগুলো মৌলিক ও জনকল্যাণমূলক সেগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী ইংরেজিতে রূপান্তর করে বিদেশি বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকা, সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামে উপস্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এতে জ্ঞাননির্ভর গবেষণার পথ প্রশস্ত হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতাকে বা মৌলিক কাজকে সর্বাগ্রে মূল্যায়ন করা উচিত। সেটি না করে আমরা ইংরেজি ভাষার জ্ঞানকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। এর ফলে আমাদের গবেষণার কাজ বিদেশি ভাষার জ্ঞানের আবর্তে গতি হারাচ্ছে। গবেষণা ইচ্ছুক অনেকেই ভাষার দুর্বলতার কারণে তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু সঠিকভাবে তুলে ধরার স্পৃহা পাচ্ছেন না। দেশ পিছিয়ে পড়ছে।

মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ও প্রবল ভালোবাসা মানুষের মধ্যে এক অদৃশ্য ইতিবাচক শক্তির জন্ম দেয়, যা মানুষকে যেকোনো বিষয়ে সফলকাম করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভাষা যদি এক হয়, তাহলে এই দুইয়ের সমন্বয়ে জাতির জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবেই হবে। এই সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডারই আমাদের নিয়ে যাবে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত শিখরে।

 

লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036590099334717