আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী হোক কিংবা বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী হোক, কারও বিরোধিতাই পছন্দ করতেন না নড়াইল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বি এম কবিরুল হক মুক্তি। যারাই তার মতের বিরোধিতা করেছেন, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে সাবেক এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে।
বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, কবিরুল হক মুক্তি ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের দলীয় কার্যক্রমে বাধা দিয়েছেন বহুবার। কেউ তার বিরুদ্ধে গেলে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এমনকি বাদ যায়নি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও। মতের বিরোধিতা করায় তাদের ওপরও চড়াও হয়েছেন মুক্তির লোকজন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নড়াইল-১ আসন সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন, কালিয়া পৌরসভা ও কালিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। বি এম কবিরুল হক মুক্তি ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কালিয়া পৌরসভার মেয়র থাকা অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময় টানা দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে কোন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কে হবেন, তাও নির্ধারণ করতেন মুক্তি। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সভাপতি বানাতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্র জানায়, স্কুল-কলেজের সভাপতি হওয়ার জন্য কবিরুল হক মুক্তিকে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দিতে হতো। আবার সেসব স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার সময় আবার নতুন করে টাকা দিতে হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ৮ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হতো এমপিকে। টাকা না দিলে নিয়োগ স্থগিত করে রাখা হতো।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনি এলাকায় গ্রুপিং সৃষ্টির কারণে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সাবেক এমপি মুক্তির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত রাখতে তার নির্বাচনি এলাকার সব ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যায়ে গ্রুপিং সৃষ্টি করা। মুক্তির আমলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই জনপদে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর।
স্থানীয়রা জানান, তার এলাকায় উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে স্থানীয় প্রশাসনকে চাপ দিতেন মুক্তি। সংসদ সদস্য হয়েও নিয়ম ভেঙে এলাকায় ভোটে প্রভাব বিস্তার করতেন। সবশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সকল প্রার্থী আওয়ামী লীগের হলেও নিজ পছন্দের প্রার্থী শামীম রহমানকে বিজয়ী করতে মাঠে নামেন এবং বিজয়ী করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া এমপির পরিবারের বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়মিত চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ। কালিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক ও কালিয়া দলিল লেখক বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্যসচিব উৎপল সিকদার জানান, সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ-বাণিজ্যের টাকা নিতেন মুক্তি ও তার স্ত্রী চন্দনা হক এবং চাচাতো ভাই জামাল বিশ্বাস। অফিসের নৈশপ্রহরী সৈয়দ নাজমুল হুদার মাধ্যমে এই টাকা নিতেন তারা। প্রতি মাসে মুক্তি ও তার স্ত্রী ১ লাখ টাকা করে চাঁদা নিতেন। মুক্তির ভাই জামাল বিশ্বাস নিতেন ৫০ হাজার করে। আওয়ামী লীগের আরও অনেকেই টাকা নিতেন। জমির ক্রেতা-বিক্রেতাকে বিভিন্নভাবে জিম্মি করে জামাল বিশ্বাস টাকা নিতেন বলেও অভিযোগ আছে। এ ছাড়া দলিললেখক সমিতিতে থাকা লেখকদের টাকাতেও মুক্তির পরিবার ভাগ বসাতেন।
সাবেক এমপি বি এম কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে জেলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। তবে দলের দুর্দিনে নেতারা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাননি।
কালিয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক স ম রাকিবুজ্জামান পাপ্পু বলেন, “ভোট ডাকাতির মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মুক্তি তার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে কালিয়ায় সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপির শতশত নেতা-কর্মীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। বিএনপি নেতা-কর্মীর কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঢাল করে কাল্পনিক ঘটনা ঘটিয়ে ‘নাশকতা’ মামলা দিয়েছেন।” মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুক্তি ও তার লোকজন অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
কালিয়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কামাল সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার নামে ৮টি নাশকতার মামলা হয়েছে। বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সর্বশেষ গত ছয় মাস আগে নাশকতা মামলায় জেল খেটে বের হয়েছি। আমাদের প্রত্যেকটা নেতা-কর্মীর নামে মামলা হয়েছে।’ সব মামলা সাবেক এমপি মুক্তির ইন্ধনে হয়েছে বলে দাবি তার।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর নড়াইল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বি এম কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। এরপর থেকে আত্মগোপনে চলে যান চারবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কবিরুল হক মুক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।