টিএসসি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ উচিত হবে না - দৈনিকশিক্ষা

টিএসসি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ উচিত হবে না

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। সংবাদটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসি নামে খ্যাত (যে স্থাপনাটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে) স্থাপনাটি ভেঙে ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উদ্‌যাপনের আগেই একটি আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর কয়েকটি স্থাপনার কথা চিন্তা করলে যে কটি স্থাপনা আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, সেগুলো হলো কার্জন হল, টিএসসি ও সলিমুল্লাহ হল। এর মধ্যে সারা বাংলাদেশের আপামর মানুষের কাছে টিএসসিই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। ১৯৬০ দশকের শুরুতে এই স্থাপনার নকশা করেছিলেন বিখ্যাত গ্রিক স্থপতি কনস্ট্যান্টিন ডক্সিয়াডেস। পরবর্তী সময়ে এটিই হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।

টিএসসিতে আছে একটি তিনতলা ভবন। সেখানে আছে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আলাদা নিজস্ব অফিস/ল্যাব, একটি অডিটোরিয়াম ভবন, ছাত্র–শিক্ষকদের ক্যাফেটেরিয়া, ইনডোর গেমস—যেমন: ক্যারাম ও টেবিল টেনিস খেলার কক্ষ, একটি সুবিশাল সবুজ লন, ছোটখাটো একটি আবাসিক গেস্টহোম। এগুলোর প্রতিটিই সুন্দর ছাদসহ করিডর দ্বারা কানেকটেড, যেন বৃষ্টিতেও কেউ না ভেজে।

তা ছাড়া টিএসসির সামনেই আছে একটু খোলা জায়গা, যেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া টিএসসিকে কেন্দ্র করে এর রাস্তার ধার ঘেঁষে আছে বেশ কিছু টি–স্টল। এই স্টলগুলোরও একটা ঐতিহ্য আছে। বাংলা নববর্ষ থেকে শুরু করে বাঙালির যত অনুষ্ঠান আছে, সেগুলো উদ্‌যাপনের কেন্দ্রবিন্দু হলো টিএসসি। স্বাধীনতা ও স্বৈরাচারবিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে, সেগুলোরও কেন্দ্রবিন্দু এই টিএসসি।

দেশে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে সাহায্যের জন্য নানা উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুও এই টিএসসি।


এ রকম একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সৌন্দর্য নষ্টের প্রথম ধাক্কাটা আসে এর পাশ দিয়ে মেগা প্রজেক্ট মেট্রোরেল স্থাপনা যাওয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাক্কাটি আসে, যখন শুনতে পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবনটিকে ভেঙে তার স্থলে একটি আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হবে।

এ রকম একটি সংবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র–শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক শঙ্কা তৈরি হয়। প্রথমত, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কারও কোনো মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শোনা যাচ্ছে, এটি ভেঙে এখানে বহুতল ভবন করা হবে, যেখানে থাকবে দু–তিনতলা পর্যন্ত পার্কিং লট, সুইমিং পুল, জিমনেসিয়ামসহ অন্যান্য বর্তমান সুবিধা। এখানে কেন সুইমিং পুল করতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে একটি সুইমিং পুল আছে। প্রয়োজনে সেটিকে আরও আধুনিক করুন। এখানে কেন জিমনেসিয়াম করতে হবে?


আমাদের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠসংলগ্ন জীর্ণশীর্ণ পুরোনো একটি জিমনেসিয়াম আছে। সেটিকে আগে বড় করে আধুনিক একটি জিমনেসিয়াম বানানো হোক। এমনিতেই মেট্রোরেলের কারণে এর সৌন্দর্য অনেকটা ঢাকা পড়বে। এবার সুউচ্চ বা বহুতল ভবন তৈরি করলে এর নান্দনিকতা ও ঐতিহ্য কোনোটিই থাকবে না।

তা ছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয় মাস্টারপ্ল্যানের ভিত্তিতে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হওয়া সব স্থাপনার স্থাপনার স্থাপত্যশৈলীতে একটি সামগ্রিক সাযুজ্য থাকে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো মাস্টারপ্ল্যান ধরে গড়ে উঠছে না। যখন-তখন বিভাগ, গবেষণা সেন্টার খোলা হচ্ছে। তারপর সেগুলোর জন্য যেখানেই খালি জায়গা পাচ্ছে, ভবন নির্মাণ হচ্ছে। ভবনগুলোর মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা–সাযুজ্য নেই। এইরকমভাবে খোলামেলা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি কংক্রিটের বস্তি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত মানুষের ঘনত্বের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু উচ্চশিক্ষিত মানুষের সবচেয়ে ঘনত্বপূর্ণ জায়গা, তার প্রতিফলন এর স্থাপনাশৈলীতেও থাকা বাঞ্ছনীয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে নেই। এটির দিকেও আমাদের নজর দেওয়া জরুরি।

টিএসসি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ একদম উচিত হবে না। আমাদের যদি খরচ করার মতো টাকা থাকে, তাহলে এর চেয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সেই টাকা খরচের জায়গা আমাদের রয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ এবং এটিকে অনেকটা গুদাম ঘরের মতো মনে হয়। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন–চার হাজার শিক্ষার্থী ছিল, তখন যত বড় লাইব্রেরি ছিল, আজ ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্যও সেই একই সমান লাইব্রেরি রয়েছে। এর কোনো উন্নতি হয়নি।


সাধারণত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি হওয়া উচিত স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য এবং পরিবেশের দিক থেকে মনোরম, যাতে সেখানে গেলে পড়তে মন চাইবে। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের চরম আবাসিক–সংকটের কারণে আবাসিক হলগুলোয় পড়াশোনা করার কোনো পরিবেশ নেই। তাই বিশাল স্থাপনাসমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি বানানো প্রায়োরিটির দিক থেকে এক নম্বরে থাকা উচিত।

তা ছাড়া আবাসিক সংকট নিরসনে ছাত্রদের জন্য আরও বেশি আবাসিক হল নির্মাণ করা উচিত। আমরা ছাত্রদের জন্য আবাসিক হল নির্মাণ না করে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য বিশাল বিশাল বহুতল ভবন নির্মাণ করছি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি আর শহীদ মিনারের মাঝখানে দুটো বহুতল ভবন হয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এমন কুৎসিত স্থাপনা কীভাবে তৈরি করা সম্ভব! এর একটিতে তিন রাস্তার মোড়ে একখানা কোনা বের করে রাস্তা এবং ভবনের মধ্যে কোনো জায়গা না রেখে বানাল!

এই দুটি কুৎসিত ভবনের পর এখন টিএসসিকে বহুতল করার চেষ্টা। প্রথম কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কি শিক্ষক–কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন তৈরি করা খুব প্রয়োজন ছিল? এটা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাকি আবাসিক এলাকা? আবাসনের ব্যবস্থা যদি করতেই হয়, সেটা করা উচিত শিক্ষার্থীদে জন্য। শিক্ষক–কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন বানিয়ে জায়গা দখল করে ক্যাম্পাস নষ্ট করা উচিত নয়। বিশ্বের কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া, ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাসিক ভবন আর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ভবন। সেখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবনের কোনো স্থান নেই।

টিএসসি ভেঙে নতুন মাল্টিপারপাস বহুতল ভবন করা হবে কি না, এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের অনলাইনে মতামত চেয়েছে। মতামতে ভেঙে ফেলার পক্ষে ভোট বেশি পড়লেই কি প্রমাণিত হবে ভাঙাটাই যৌক্তিক? আমাদের দেশের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা কি স্বাধীনভাবে কিছু চিন্তা করতে পারেন? শিক্ষক সমিতি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন নির্বাচনে সাদা–নীল রঙের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো মানুষটি নির্বাচনে দাঁড়ালেও বড়জোড় কয়েকটা ভোট পাবেন।

জাতীয় নির্বাচনে মানুষ মার্কা দেখে ভোট দেন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রং দেখে ভোট দেন। পার্থক্য আছে কি? প্রশাসন যেহেতু বলেছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এটি হচ্ছে, সেহেতু সরকারি দলের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা চোখ বুজে ভাঙার পক্ষে ভোট দেবেন। সবকিছু ভোটে হয় না। খুব ভালো জিনিসের মর্যাদা সবাই বুঝতে করতে পারে না।

আরেকটা কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকার কাজকর্ম সবকিছুই ঠিক হওয়া উচিত এখানে। সরকারের কাছে বরাদ্দ চাওয়া যেতে পারে। সরকার বরাদ্দ দেবে। এরপর সরকার বা আমলাদের আর কিছুই করার নেই।

লেখক : কামরুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। 

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032868385314941