জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি। তথ্যপ্রযুক্তির কাজে টেলিযোগাযোগের জন্য দুর্গম এলাকা বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ স্থাপন ও উদ্বোধন করেন। সে যুগের আধুনিক তথ্য সম্প্রচারের দিগন্ত ভূ-উপগ্রহ। ১১টি দেশের সঙ্গে টেলিফোন ডাটা কমিউনিকেশন, ফ্যাক্স, টেলেক্স ইত্যাদি আদানপ্রদানের সুবিধা বঙ্গবন্ধুর হাতে এদেশের ভিত্তিভূমিতে প্রথম স্থাপিত হয়। সেই ১৯৭৫-এর ১৪ জুন। অথচ আজ? অবাক কাণ্ড! মহাশূন্যে উড়ছে আমাদের স্যাটেলাইট! বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। বাঙালির স্বাধীন সত্তা বিকাশের বড়ো প্রতীক— জয় বাংলা খচিত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাশূন্যে। উন্নয়নের অভিনব যাত্রায় এগিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের নতুন বাংলাদেশ— স্যাটেলাইটের যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে স্যাটেলাইট উেক্ষপণকারী ৫৭তম দেশ। জাতি হিসেবে ব্যাপারটা আমাদের জন্য অবশ্যই গৌরবের। সোমবার (১৬ মার্চ) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, এখন বিশ্বায়নের যুগ। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সময়। ডিজিটাল সময়। মাত্র ১০ বছর সময়ের মধ্যে সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল হয়ে উঠেছে। চারপাশে চোখ মেলে তাকালে অন্ধকারেও চোখে পড়ে নীলাভ আলো। তার মানে স্মার্ট গ্যাজেটে দরকারি কাজ হচ্ছে। হাতে হাতে অ্যান্ড্রয়েডে তথ্যপ্রযুক্তির ছড়াছড়ি। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ আর তরুণদের হাত ধরে দেশে স্মার্ট গেজেট, ওয়াইফাইয়ের ব্যবহার বেড়ে গেছে। ডিজিটাল কমিউনিকেশনের প্রভাবে বাঙালির জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। দ্রুত বদলে গেছে মানুষের চিন্তাভাবনা ও চাহিদার ধরন। ধরা যাক, ফেসবুক। দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী ৬ কোটির বেশি। এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা। ডিজিটাল কমিউনিকেশনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বাতাসে সামাজিক মিডিয়ার সুবিধা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানান উদ্যোক্তা। রূপকথা নয়। কী চমত্কার ডিজিটাল ম্যাজিক! অনলাইন পর্দা জুড়ে বসে গেছে যাবতীয় ব্যবসায়-পণ্যের ভিজুয়াল হাটবাজার। তাও আবার হাতের তালুতে। সব সময়। এক ক্লিকে। ডিজিটাল এই বিপণন স্মার্টফোনকে শপিং ব্যাগ আর দোকানে পরিণত করেছে। আগে আমাদের কোনো পণ্য কিনতে হলে মার্কেটে যেতে হতো। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ঘরে বসেই নিজের ইচ্ছানুযায়ী খুব সহজে এখন জিনিসপত্র কেনাবেচা করা যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পড়াশোনা— সবকিছু হয়ে গেছে ডিজিটাল।
শুধু কি তা-ই! তৈরি হয়েছে স্মার্টকার্ড, ডিজিটাল লাইসেন্স, পাসপোর্ট, ইউনিক আইডির বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ। এতে সেবা প্রদান হয়েছে সহজ ও স্বচ্ছ। দুর্নীতি, অপরাধ, জুচ্চুরি জালিয়াতি করে কারো পালানোর পথ নেই। ১০ কোটি ডিজিটাল আইডি এখন নাগরিকের হাতে হাতে। এছাড়াও ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা, ডাটাবেজের মাধ্যমে দুস্থ ও বিধবা মহিলাদের ভাতা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান তো রয়েছেই। ওয়েবভিত্তিক চাকরি, ব্যাংক, সিটি করপোরেশন নাগরিক হেলপ ডেস্ক, এসএমএসের মাধ্যমে গ্যাস, ফোন, বিদ্যুত্ বিল, রেলওয়ের অনলাইন টিকিট, যাত্রীদের তথ্যসেবা, মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য ডাটাবেজ, পারসোনাল ডাটাশিট (পিডিএস) অনলাইন প্রদর্শন, প্রিন্ট ইত্যাদি জরুরি কাজে এখন কোনো মানুষ লাগে না। ‘হয়ে যা’ বললেই হলো। আঙুলের স্পর্শেই হয়ে যায়। মানুষের দোরগোড়ায় তথ্য ও সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য চালু রয়েছে জাতীয় তথ্য বাতায়ন। এই তথ্য বাতায়নের ৪৫ হাজার ওয়েবসাইট ও সরকারি বিভিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু কি তা-ই? গুগল প্লে স্টোরে রাখা হয়েছে ৬০০ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক নাগরিক নিজেদের প্রয়োজনে এসব অ্যাপ্লিকেশন স্মার্টফোনে বিনা মূল্যে ডাউনলোড ও ইনস্টল করে ব্যবহার করছেন। কঠিন কাজ হয়ে যাচ্ছে একদম সহজ। জলবত্ তরলং। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক এসব অ্যাপের মাধ্যমে পাচ্ছেন কৃষিসংক্রান্ত বিভিন্ন দরকারি তথ্য।
প্রতারণা বা সহিংসতার শিকারে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে পুলিশের জরুরি সেবা। মত্স্য ও পশুসম্পদ তথ্যকেন্দ্র এখন হাতের মুঠোয়। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সার্বক্ষণিক চালু রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদভিত্তিক তথ্যকেন্দ্র। আর কী চাই। মানুষের জরুরি সেবাগুলোর প্রাপ্তি সহজ হয়েছে। এভাবে ডিজিটাল গভার্নেন্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণ ও সরকারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে উদার গণতান্ত্রিক নৈকট্য। ইতিমধ্যে ডিজিটাল ইভিএমে প্রথম ভোট ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে (স্বল্প ভোটার উপস্থিতি হলেও) নিরপেক্ষতার নজির স্থাপন করেছে। ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ফলপ্রসূ হচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলেও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর। দামে সস্তা বড়ো বড়ো এলইডি মনিটর, প্রজেক্টর, ডিজিটাল অ্যান্ড্রয়েড গেজেটের ব্যবহার বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের চারদিকে এখন জয়জয়কার দেখা যায়।
ডিজিটাল বাংলাদেশে ‘উবার-পাঠাও’-এর মতো রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায় যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি যাতায়াতেও বেড়েছে সুবিধা। ঘরে বসে মুঠোফোনকে বললেই হলো। ‘ওভাই’, ও বোন, আমার জন্য একটা ‘উবার’ ‘পাঠাও’ তো, ‘সহজ’ হয়ে যায়! ঘরে বসেই নগদ, বিকাশ, ইউক্যাশ, শিউর ক্যাশ প্রভৃতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুহূর্তেই পাঠানো যাচ্ছে টাকা আপনজনদের কাছে। গ্রামের মায়েরা উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছেন হাতে হাতে, ঘরে বসে। এজন্য আগের মতো কয়েক কিলোমিটার দূরে ব্যাংকে যেতে হয় না। এছাড়াও রয়েছে ডিজিটাল খাতের একটি বড়ো অংশ (সাড়ে ৬ লাখ) আউটসোর্সিং করা ফ্রিল্যান্সার। গড়ে উঠেছে সফটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তা। নারীদের ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যুক্ত করায় এ খাতে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণেই গ্লোবালাইজেশন যুগে বাঙালি প্রজন্ম একই বিশ্বছাতার নিচে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অনন্য সুযোগ পেয়েছে। গুগল, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও অনান্য প্ল্যাটফরম মানুষের জীবনকে করেছে অনেক সহজ ও আধুনিক। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে যা ব্যাপক গুরুত্ব বহন করছে।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ এই প্রজন্মের জন্য সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে। প্রমাণিত হয়েছে এ নীতি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনেই শুধু নয়, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করায় নিঃসন্দেহে বড়ো অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের ওপরে। আজ আর গল্প-উপকথা নয়—পদ্মা সেতু। চোখেই দেখা যায়। তাই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হলো একুশ শতকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত বিশ্বের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলুক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, জন্মভূমি—‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’।
লেখক : শেখ আনোয়ার, বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।