ড্রাইভারকে দেয়া হচ্ছে উপসচিবের সমান বেতন - দৈনিকশিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪১ দফা সতর্কবার্তাড্রাইভারকে দেয়া হচ্ছে উপসচিবের সমান বেতন

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রাইভারকে দেওয়া হচ্ছে পঞ্চম গ্রেড বা উপসচিবের সমান বেতন। বয়স পার করার পরও ‘সেশন বেনিফিটের’ নামে পরের জুন পর্যন্ত রাখা হয় চাকরিতে। শুধু তাই নয়, বাংলোতে থাকার পরও উপাচার্য নেন বাড়ি ভাড়া। এভাবে অন্তত ২০টি খাতের আড়ালে উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিধিবহির্ভূতভাবে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। তবে, ইউজিসির কতিপয় কর্মকর্তা এসব অপকর্মের সহায়ক। তারা নিজ নিজ স্ত্রী-স্বামী, পুত্র-কন্যা-শ্যালিকা-ভাতিজাদের এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়ে আসছেন বহু বছর ধরে। আবার কতিপয় সাংবাদিকের আত্মীয়-স্বজনদেরও চাকরি দেয়া হয় রিপোর্ট না প্রকাশের শর্তে।

দেশে বর্তমানে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ও পিছিয়ে নেই। আর্থিক প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনতে দু-একদিনের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানকে ৪১ দফা সংবলিত সতর্কপত্র পাঠানো হচ্ছে। সোমবার ইউজিসির পূর্ণ কমিশনের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইউজিসির সদস্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ডে নিজেদের প্রয়োজনমতো নিয়ম পাশ করে নিতে পারে। এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণের নিয়ম পাশ করে নিয়েছেন কেউ কেউ। ইউজিসির হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের দীর্ঘ অনুসন্ধান ও তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ নিয়ে কমিশনের বৈঠকে সুনির্দিষ্ট আলোচনার পর সতর্ক করার লক্ষ্যে পরিপত্র জারির সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ২০ খাতে বিধিবহির্ভূত আর্থিক সুবিধা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে-উচ্চতর স্কেলে বেতন প্রদান; বিধিবহির্ভূতভাবে পঞ্চম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তাকে তৃতীয় গ্রেড প্রদান; ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও স্কেল প্রদান, যোগদানের তারিখ থেকে পদোন্নতি; অননুমোদিত পদে নিয়োগ, আপগ্রেডেশন ও বেতন প্রদান; অনর্জিত ইনক্রিমেন্ট প্রদান; বেতনের বাইরে নানান নামে উপাচার্য হিসেবে অতিরিক্ত অর্থগ্রহণ; বাংলোতে বসবাস সত্ত্বেও বাড়ি ভাড়া গ্রহণ; পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পরও কম নেওয়ার উদ্দেশ্যে বর্গফুটের হিসাবে ভাড়াগ্রহণ। এছাড়া আছে-মফস্বলের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-জনবলকে সিটি করপোরেশনের হিসাবে বাড়িভাড়া প্রদান; এর বাইরেও সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া প্রদান; সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে সেশন বেনিফিট প্রদান; পিআরএলের পরিবর্তে এলপিআর প্রদান; বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল ভর্তুকি দেওয়া; গবেষণা-মোবাইল-টেলিফোন-ইন্টারনেট ভাতা প্রদান, নিয়মের বাইরে বইভাতা দেওয়া; ড্রাইভারদের নবম থেকে পঞ্চম গ্রেডে বেতন দেওয়া; চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে সরকারের আর্থিক নীতিমালা লঙ্ঘন এবং যৌথ বিমা বা কল্যাণ তহবিলে (অর্থ) স্থানান্তর।

জানা গেছে, ড্রাইভারদের ‘টেকনিক্যাল অফিসার’ দেখিয়ে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সমান বেতন-ভাতা দেওয়া হয় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি, মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুয়েটে। ইসলামী, খুলনা, শেরেবাংলা কৃষি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি, খুলনা কৃষি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের উপাচার্যরা কেউ বিশেষ ভাতা, কেউ বা দায়িত্ব ভাতার নামে বেতনের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ হারে অর্থ নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ছয় ধরনের নাম দেখা যায়। বাংলো থাকার পরও উপাচার্যকে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় চট্টগ্রাম, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নিয়োগের দিন থেকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নয়ন বা উচ্চতর স্কেল নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বুয়েট এবং রুয়েটে। সহকারী রেজিস্ট্রারের নবম গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা। কিন্তু নিচ্ছেন ৫ম বা ষষ্ঠ গ্রেডে। আর উপরেজিস্ট্রারের ৭ম গ্রেডে নেওয়ার কথা। নিচ্ছেন চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডে। এই ঘটনা ঘটে চলেছে ঢাকা ও রাজশাহীসহ ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নানান কারণ দেখিয়ে অনর্জিত ইনক্রিমেট হিসাবে সর্বোচ্চ ৬টি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পর বর্গফুটে কম ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে ঢাকা, বাকৃবি, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামী এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন প্রতিষ্ঠান।

 ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের বড় একটি খাত হচ্ছে ঢাকায় রেস্ট হাউজ বা লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন। উপাচার্যরা ঢাকার বাইরে না যাওয়ার লক্ষ্যে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে এগুলো স্থাপন করে থাকেন। আবার ঢাকায় অবস্থানের সুবিধার্থে শিক্ষক-জনবলের জন্য রেস্ট হাউজ রাখা হয়েছে। সবমিলে অনেকটা বেপরোয়াভাবেই শিক্ষক-কর্মচারীদের অবৈধ উপায়ে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে একশ্রেণির ভিসি প্রধান ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তারা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের সরকার স্পর্শ করতে পারবে না এমন কথাও প্রকাশ্যে বলে থাকেন।

৪১ দফা সতর্কতা : সব অনিয়ম বন্ধে দু-একদিনের মধ্যে যে সতর্কপত্র পাঠানো হচ্ছে, তাতে ৪১টি দফা আছে। মূলত জুন মাসে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক বছরের বাজেট তৈরি হয়। এটিকে সামনে রেখেই এই পরিপত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় কমিশনের বৈঠকে। এতে ইউজিসির সদস্যসহ তিনটি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডিনরা যোগ দেন। বৈঠকে দেশের ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ খাতে আসন্ন বছরে ১০ হাজার ৫১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি ৪ লাখ টাকা, আর ইউজিসির জন্য ৭১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। গত বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ বেড়েছে ৯৩৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

 পরিপত্রে আগামী ১০ জুনের মধ্যে ৫০ বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ও নতুন বছরের প্রাথমিক বাজেট পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরিপত্রে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনার মধ্যে আছে-প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করতে হবে। আর এই আয় নিজস্ব আয়ের মধ্যে অবশ্যই দেখাতে হবে। এছাড়া ভর্তি, টিউশন, পরীক্ষা, ল্যাব টেস্ট, বিশেষ কোর্স, বেতন থেকে কর্তনাদি, সম্পত্তি থেকে লব্ধ অর্থ ইত্যাদি অবশ্য নিজস্ব আয় হিসাবে বাজেটে দেখাতে হবে। বিভিন্ন প্রকার ব্যয়ে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট ও কর আদায় করতে হবে।

শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বভাতা বেতনের ১০ শতাংশ বা দেড় হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম সেটি দেওয়া যাবে। অগ্রিম দেওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। আরও আছে, এক খাতের অর্থ অন্য খাতে কিংবা মূল খাতের অর্থ অভ্যন্তরীণ কোনো খাতেই সমন্বয় করা যাবে না। কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। কোনো খাতে বাড়তি অর্থের দরকার হলে ইউজিসিকে অবহিত করতে হবে। অনুমোদিত জনবলের বাইরে কোনো প্রকার নিয়োগ করা যাবে না। বিধিবহির্ভূত নিয়োগে ব্যয়ের অর্থের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই উৎসব ও নববর্ষভাতা গ্রহণ করবেন। চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করতে হলে তাকে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে যে, তিনি অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ভাতা নেন না। এ ধরনের জনবলকে চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কনসোলিডেট পেমেন্ট ফিক্সেশনের সময়ে কোনোভাবেই উল্লিখিত দুই ভাতা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া এডহক, দৈনিকভিত্তিক বা আউটসোর্সিং করা যাবে না। আর শূন্যপদে অনুমোদনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অনুমোদন সাপেক্ষে নিয়োগ করা যাবে।

পরিপত্রে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার বা ডরমেটরিতে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের প্রচলিত নিয়মে আদায় করতে হবে। সুবিধাভোগীর কাছ থেকে অন্যান্য (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস) প্রকৃত বিল আদায় করতে হবে। কোনো রূপ ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। পুরাতন যানবাহন পুনঃস্থাপন, জমি/ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা বাড়ি ভাড়া, পেনশন-বিধি ও আর্থিক বিষয়ে প্রণীত নীতিমালাসহ অন্যান্য অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুমোদনের জন্য ইউজিসিতে পাঠাতে হবে।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049049854278564