রুমের মেঝেতে সারি সারি বিছানা। তার উভয় পাশে সারিবদ্ধ ট্রাঙ্ক। রুমের বিভিন্ন কোণ বিভিন্ন জিনিসপত্রে ঠাসা। একটু ফাঁকা জায়গাও চোখে পড়ে না গণরুমে। প্রায় দম বন্ধ করা পরিবেশ। সেখানেই থাকতে হয় ২০ থেকে ২২ জনকে। ঘুমন্ত অবস্থায় একজনের পায়ের সঙ্গে লেগে যায় আরেকজনের মাথা। অনেক সময় ঘুমাতে হয় পালা করে। এমনই চিত্র চোখে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের গণরুমগুলোতে। রোববার (১ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাব্বির নেওয়াজ ও ইমাদ উদ্দিন মারুফ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গণরুম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেরই অংশ, তা জানা না থাকলে হঠাৎ করে প্রথম দেখায় ভড়কে যেতে পারেন, শরণার্থী শিবির মনে করতে পারেন। শুয়ে থাকা, ঘুমিয়ে পড়া সারি সারি শিক্ষার্থীকে দূর থেকে দেখে ভাবতে পারেন, আড়তে ফাইল করে রেখে দেওয়া ইলিশ। শিক্ষার্থীদের এমনভাবে দেখে মনে হয়, উচ্চশিক্ষা নেবে কি, ওরা যে এই দুর্বিষহ অবস্থায় বেঁচে আছে- সেটাই তো যথেষ্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলেই রয়েছে গণরুম। ১৮টি আবাসিক হলে মোট গণরুম ১৩০টির মতো। এ ছাড়া হলের বারান্দা, ছাদ, গেমস রুম, এমনকি মসজিদেও থাকছেন অনেকে। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা চার হাজারের কম হবে না। একজন নবীন শিক্ষার্থী আবাসিক হলে ওঠামাত্র মুখোমুখি হন এমন পরিস্থিতির। কেউ কেউ এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে অন্য কোথাও চলে যান। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই অর্থের অভাবে নিরুপায় হয়ে অবস্থান করেন সেখানে। তা ছাড়া গণরুমে ওঠার পর থেকে রোগব্যাধির সঙ্গেও বসবাস শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের। ডেঙ্গু, চর্মরোগ- যেটাই হোক, রুমের একজনের হলেই তাতে আক্রান্ত হয় অন্য সবাই। নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে অনিদ্রা আর উদ্বেগ। ঘুমানোর জন্য পাতা স্বল্প পরিসরের জায়গাটিতে পড়াশোনা করতে পারেন না তারা। যদিও সেই ঘুমও হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। তবে গণরুমের ইতিবাচক একটি দিকের কথাও বলেছেন অনেকে। তাদের মতে, এখানে থাকায় অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক মনোভাবও তৈরি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের গণরুম পরিদর্শনের সময় কথা হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। গণরুমের গল্প কাছে তুলে ধরেন তারা। তাদের একজন জাফর আলী। শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের এ শিক্ষার্থী থাকেন হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে। তিনি বলেন, 'ভর্তি পরীক্ষার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক প্রত্যাশা ছিল। ভর্তি পরীক্ষায় টিকে তাই অনেক খুশি হয়েছিলাম। তবে হলে ওঠার পর এমন আবাসন সমস্যার মুখে পড়ব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। বস্তির চেয়েও হলের গণরুমের অবস্থা খারাপ। অর্থনৈতিক কারণে, তা ছাড়া নিরাপত্তার কথা ভেবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী হলে থাকেন। তারপরও প্রত্যাশা পূরণ হয় না।' অবশ্য ছাত্রীদের হলের অবস্থা ছাত্রদের হলগুলোর তুলনায় ভালো বলে মনে করেন তিনি।
গণরুমের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক তুলে ধরে জাফর আলী বলেন, 'গণরুমে সবাই একসঙ্গে থাকতে থাকতে সখ্য গড়ে ওঠে। রাতে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে একটা বন্ধন তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মেশা হয়, তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। তবে এখানকার একটা বড় নেতিবাচক দিক হলো, ক্লাস শেষ করে অথবা অনেকদিন ক্লাস বাদ দিয়ে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতে হয়। ফলে নিজেদের সময় নষ্ট হয়।'
একই হলের আরেক শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, 'এমন অবস্থায় থাকতে হয় যে, আত্মীয়স্বজন কাউকে আনা যায় না। তারা আমাদের থাকার জায়গা দেখে বিশ্বাসই করবেন না, দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের আবাসন ব্যবস্থা এমন হতে পারে! উদ্বাস্তুরাও মনে হয় গণরুমবাসীর চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় থাকে।' তিনি বলেন, 'গণরুম সমস্যা দূর করতে হলে প্রথম বর্ষ থেকেই মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করতে হবে। হলের হাউস টিউটররা গণরুমের কোনোরকম খোঁজখবর নেন না। তাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্নশীল ও তৎপর হতে হবে।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি তার জুনিয়রদের এটুকুই বলতে চান, এখানে ভর্তি হলে তারা যেন হলে না ওঠে। তারা যেন বাইরে থাকে। আর সেই সুবিধা না থাকলে যেন এখানে ভর্তিই না হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের ক্রীড়াকক্ষ এখন ব্যবহার হচ্ছে গণরুম হিসেবে। রুমটিতে থাকেন ২-৩শ'র মতো ছাত্র। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র তানভীর মায়েদ তাদেরই একজন। তিনি বলেন, 'প্রথম যখন হলে উঠলাম, তখন গণরুমের পরিবেশ দেখে মনে হয়েছিল, এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ঢাকায় তেমন আত্মীয়ও ছিল না। তা ছাড়া হলে থেকে অন্তত ক্লাস করতে সুবিধা হয়। তাই কষ্ট হলেও গণরুমেই উঠেছি। এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রথমে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। পরে তাদের সঙ্গে আড্ডা আর রাতে ঘোরাঘুরি করতে করতে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে।' পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় গণরুম বলে জানান তিনি।
তানভীর মায়েদ বলেন, 'গণরুমে পড়াশোনা হয় না। রাতে ঠিকমতো ঘুমানো যায় না। আবার সকাল ৮টার মধ্যেই বাধ্যতামূলকভাবে উঠতে হয়। ছারপোকার কামড়, নোংরা পরিবেশ, বাথরুম সংকটসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া গণরুমের শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন পূর্বপরিকল্পনা যা-ই থাক না কেন, সেটি আর করা হয় না। এদিকে সকাল ৬টার মধ্যে রিডিংরুমে ঢুকতে না পারলে দিনের বেলা সেখানে আর বসার জায়গা পাওয়া যায় না। জায়গা মেলে একেবারে সেই রাত ১১টার পর। কিন্তু সারাদিনের ধকল শেষে অনেক রাত অবধি পড়ে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাস করা ভীষণ কষ্টের।'
তবে এর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে বলে জানান তানভীর। তার মতে, 'এখানে একসঙ্গে থাকায় নিজেদের মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। কেউ কোথাও বিপদে পড়লে সবাই মিলে তাকে সাহায্য করে।'
তানভীর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত। হল প্রশাসনের মাধ্যমে সিট বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দিয়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের সিট দিতে হবে। এতেও আবাসন সমস্যার সমাধান না হলে ছাত্রী হলের মতো 'দ্বিতল বিশিষ্ট বিছানা'র ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান মিয়া থাকেন সূর্য সেন হলে। তিনি বলেন, 'ঢাকায় থাকার তেমন ব্যবস্থা না থাকায় উঠতে হয় এখানে। একসঙ্গে ছোট একটা রুমে থাকতে হয় ২২ জনকে। নিজের মতো করে থাকা এখানে সম্ভব নয়। পড়াশোনারও বেশ ক্ষতি হয়। তবে এখানে থাকলে কেউ বিপদে পড়লে অন্য সবাই মিলে সাহায্য করে তাকে। এর বেশি গণরুমের কোনো ইতিবাচক দিক দেখি না। সবাই বলে যে, এখানে 'ম্যানার' শেখানো হয়, অন্যদের সঙ্গে কীভাবে চলতে হয়, সেটি শেখানো হয়। এটা ঠিক নয়। কেননা এর আগে কি আমি মানুষের সঙ্গে চলিনি? ডিপার্টমেন্টে বা অন্য কোথাও আমার কি কোনো বন্ধু নেই? তাহলে গণরুমে থেকে কেন মানুষের সঙ্গে চলা শিখতে হবে?' তিনি বলেন, 'প্রশাসনের উচিত, হলের বহিরাগত-অছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। মেধার ভিত্তিতে শুরুর দিকেই শিক্ষার্থীদের সিটের ব্যবস্থা করা।'
সরেজমিনে দেখা গেছে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের চিত্র আরও ভয়াবহ। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হয়েছে বারান্দায়। ঘিঞ্জি এক বারান্দায় লম্বা করে বিছানো চৌকি। এমন চৌকিতেই ঘরবসতি তাদের। মাথার ওপর একটিও ফ্যান নেই। কারও কারও অবশ্য ব্যক্তিগত ফ্যান আছে। কিন্তু যাদের নেই তাদের একমাত্র ভরসা প্রকৃতির হাওয়া। বারান্দা বলে রোদ আসে, কখনও কখনও তাপে টেকা যায় না। আবার বৃষ্টি হলেই ভিজে যায় সব। প্রায়ই ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বারবার অভিযোগ জানানোর পর হয়তো এসব ক্ষত সারায় প্রশাসন।
প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা :এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট নিরসন ও গণরুম সমস্যা সমাধানের দাবিতে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে নিজের সিট ছেড়ে গণরুমে থাকছেন ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। ৩ সেপ্টেম্বর গণরুম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে উপাচার্যের কাছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার আহ্বানের পাশাপাশি সাময়িক সমাধানের কয়েকটি প্রস্তাবনা সংবলিত স্মারকলিপি দেন তিনি। এসব দাবিতে ১ অক্টোবর গণরুমের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি ছাত্র সমাবেশও করেন তিনি। গত ২৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে গণরুম সমস্যার কার্যকর সমাধান না হলে বিভিন্ন হলের গণরুমের শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে থাকার ঘোষণা দেন তিনি।
এরপর গত ২৯ অক্টোবর গণরুমের শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে প্রতীকী গণরুম বানিয়ে অবস্থান নেন এই ডাকসু সদস্য। পরে প্রথম বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়া হবে- উপাচার্যের এমন আশ্বাসে অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেন তিনি। সৈকত বলেন, 'উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক। অথচ শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের সমাধান করতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবনযাপন করবে আর তিনি প্রাসাদোপম বাংলোয় আয়েশে থাকবেন, এটা কোনোভাবেই অভিভাবকসুলভ কোনো কাজ হতে পারে না।' ডাকসু সদস্য বলেন, 'আপাতত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনে আবারও গণরুমের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলনে নামব।'
প্রভোস্টরা যা বলেন :হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া জানান, 'আসলে মুহসীন হলে গণরুম বলতে তেমন কিছু নেই। টিনশেডে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা থাকে। সেখানে তারা ফ্লোরিং করে, কোনো বেড বসানো হয়নি। এগুলো সম্পূর্ণরূপে হল প্রশাসনের আওতায় এনে মেধার ভিত্তিতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়া হবে। এ ছাড়া হল থেকে বহিরাগতদের উৎখাত করার প্রক্রিয়াও চলছে। কিছুদিন আগে অবৈধ ও বহিরাগতদের বের করে ২০টি রুম সিলগালা করা হয়েছে। এভাবে অবৈধ ও বহিরাগতদের বের করলে সিট সংকট অনেকটাই দূর হবে। তখন বৈধ শিক্ষার্থীদের সেখানে রাখা যাবে।'
বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, 'গণরুম ও আবাসিক সমস্যা নিরসনে আগামী বছর সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে হল প্রশাসন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিবেচনায় নেবে। সিট খালি থাকা সাপেক্ষে তাদের যেন তা দেওয়া যায়, সেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর গণরুমে থাকার ব্যবস্থা যেন একটু স্বাস্থ্যসম্মত হয়, সেটি দেখা হবে। ইতোমধ্যে দ্বিতল বেড করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের জীবনমান আরও উন্নত করার বিষয়েও কাজ চলছে।'
উপাচার্যের ভাষ্য :এ ব্যাপারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, 'গণরুম ও আবাসন সংকট নিরসনে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণরুম সমস্যা এত দীর্ঘদিনের যে, দিনক্ষণ বেঁধে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। আস্তে আস্তে পরিকল্পিতভাবে সমাধানের দিকে এগোনো হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'বেশ কয়েকটি হল সম্প্রসারণ, নতুন হল নির্মাণ- এসব হচ্ছে এর স্থায়ী সমাধান। আর অন্যগুলো কিছু ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ঘটিয়ে দূর করা সম্ভব। কর্তৃপক্ষ তেমন কিছু পরিবর্তন আনছে। আর দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী সমাধানের জন্যও ইতোমধ্যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে।