ডেন্টাল শিক্ষার্থীরা এক-তৃতীয়াংশ বিষণ্নতায় ভোগেন - দৈনিকশিক্ষা

ডেন্টাল শিক্ষার্থীরা এক-তৃতীয়াংশ বিষণ্নতায় ভোগেন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিট থেকে বিডিএস ডিগ্রি শেষ করে একই কলেজের হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন আমিরুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তার এমবিবিএস পাস করা বন্ধুরা অবশ্য ইন্টার্নের পাশাপাশি সরকারি কিংবা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেখানে আমিরুলের সুযোগ যৎসামান্য। ফলে তাকে চেম্বার খুলে বসতে হবে। এতেও প্রয়োজন বড় অংকের মূলধন। অন্যথায় তাকে কাজ করতে হবে কোনো জ্যেষ্ঠ ডেন্টিস্টের সহযোগী হয়ে। সেক্ষেত্রে আয় খুবই কম। সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ পেশা নিয়ে রাজ্যের দুশ্চিন্তায় আছেন কঠোর পরিশ্রম করে ডেন্টাল পাস করা শিক্ষানবিশ এ চিকিৎসক। একইভাবে ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিডিএস শেষ বর্ষের ছাত্রী ইতিশা আহমেদ (ছদ্মনাম)। মঙ্গলবার (০৪ অক্টোবর)  বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়,শুধু আমিরুল বা ইতিশাই নন, দেশের ২৭ শতাংশের বেশি ডেন্টাল শিক্ষার্থী ভুগছেন বিষণ্নতায়। গবেষণায় উঠে আসা তথ্য বলছে, মূলত একাডেমিক, অসুস্থতা, ক্লিনিক্যাল পরিবেশের প্রতিকূল পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের পেশা নিয়ে হতাশা থেকেই এ বিষণ্নতা ভর করে। তবে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের মধ্যেই হতাশার প্রবণতা বেশি পাওয়া গিয়েছে। বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। জার্মানিভিত্তিক খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিঙ্গার সম্প্রতি গবেষণাটি প্রকাশ করেছে। যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও একটি দেশীয় গবেষণা সংস্থার চার গবেষক এ গবেষণা পরিচালনা করেছেন। ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও রংপুর মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষকরা দাবি করছেন, এর আগে ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। 

স্প্রিঙ্গারে প্রকাশিত গবেষণার ফলে বলা হয়েছে, ডেন্টালের ২০ শতাংশ ছাত্র বিষণ্নতায় ভোগেন আর মানসিক এ স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখে গিয়েছে ৩০ শতাংশ ছাত্রীর মধ্যে। উদ্বেগে ভোগা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছাত্রীর হার বেশি। সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতা জেঁকে বসে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওপর, ৩২ শতাংশ। এমনকি শহর এলাকায় বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও হতাশা ও উদ্বেগ বেশি থাকে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। গবেষণা বলছে, গ্রামাঞ্চলে স্থায়ীভাবে বাস করা ডেন্টাল শিক্ষার্থীর ২৩ শতাংশ আর শহরাঞ্চলের ৩১ শতাংশ চরম হতাশায় ভুগছে। আবার নিম্ন ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের চেয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই বেশি (৩২ শতাংশ) হতাশা পরিলক্ষিত হয়েছে। মানসিক অসুস্থতার পারিবারিক ইতিহাস থাকা হতাশ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আত্মহত্যারও চেষ্টা চালিয়েছেন।

গবেষণা বলছে, একাডেমিক কাজের অতিরিক্ত চাপ ও অধ্যয়নের বাধ্যবাধকতার কারণে ডেন্টালের শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভোগেন। কেননা তাদের পাঠ্যক্রম অত্যন্ত চাপের। একই সঙ্গে জটিলতা রয়েছে শেখার অনুষঙ্গ ক্লিনিক্যাল পদ্ধতিতেও। এমনকি উত্তেজনা, বিচলিত হওয়া, অস্বস্তি, অনুশোচনা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, সিদ্ধান্তহীনতা, এড়িয়ে যাওয়ার মনোভাব, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, দুঃখ, অপরাধবোধ, দোষ, বিরক্তি বিডিএস ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে হতাশা ও উদ্বেগের জন্ম দেয়। অন্যদিকে বেসরকারি ডেন্টাল কলেজের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোকে। এটিও শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়ায়। তাদের ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতাও কম থাকে। ইন্টার্নশিপেও পড়তে হয় রোগী সংকটে। আছে পরীক্ষাগারের অভাব, যন্ত্রাংশের সংকট; যা শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই যেসব চিকিৎসক সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন, এমন চিকিৎসকের কাছে যেতেই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে রোগীরা।

বিডিএস পাস করা চিকিৎসকদের মধ্যে ভবিষ্যৎ পেশাগত অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হকও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক এ উপদেষ্টা বলেন, দেশ স্বাধীনের পর দেশে আটটি মেডিকেল কলেজ ছিল। তখন আলাদা কোনো ডেন্টাল কলেজ ছিল না। একমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজেই ডেন্টাল ফ্যাকাল্টি ছিল। পরবর্তী সময়ে প্রায় মেডিকেল কলেজেই ডেন্টাল ফ্যাকাল্টি খোলা হয়েছে। প্রথম দিকে চিকিৎসকস্বল্পতা ছিল, কিন্তু এখন বাংলাদেশে যে পরিমাণ ডেন্টাল সার্জন তৈরি হচ্ছেন, সে তুলনায় চাকরি কম। তাই তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ চাকরির অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া দাঁতের চিকিৎসকদের জন্য সরকারি পদও অন্য চিকিৎসকদের তুলনায় খুব কম। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় যারা দন্ত চিকিৎসায় নিয়োজিত, তাদের আয় তুলনামূলক অন্যান্য চিকিৎসকের চেয়ে ঢের বেশি। তার মতে, দন্ত চিকিৎসকদের শিক্ষাজীবন অন্যান্য মেডিকেল শিক্ষার্থীর তুলনায় কম নয়। ক্যাডার সার্ভিসেও তারা এমবিবিএস চিকিৎসকদের সমমানের, কিন্তু তাদের শিক্ষার সুযোগ বাড়লেও চাকরির সুযোগ অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে প্রচুর দাঁতের চিকিৎসক পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাচ্ছেন না। এ অনিশ্চয়তাটা তারা লক্ষ করেন মেডিকেল শিক্ষাজীবনে প্রবেশের এক-দুই বছর পর থেকেই। এ কারণে তাদের মধ্যে হতাশা বেড়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেন্টালের ডিগ্রিধারীদের কাজের সুযোগ কম। যে পরিমাণ মেডিকেল চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়, সে সংখ্যক ডেন্টাল চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয় না। এজন্য একধরনের হতাশা তৈরি হয়। পেশাগত নিরাপত্তাবিষয়ক অন্যান্য গবেষণা বলছে, দেশে চাকরির বাজারে ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের অবস্থান খুবই কম। সাধারণ চিকিৎসকের মতো ডেন্টাল চিকিৎসকরাও উচ্চতর বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করলেও সাধারণ চাকরির ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত নন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস হেলথ) মাধ্যমে ডেন্টাল সার্জনরা কেবল সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। এছাড়া বেসরকারিভাবে তাদের চাকরির সুযোগ থাকলেও তা খুবই সীমিত।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে একটি সরকারি ডেন্টাল কলেজ ও আটটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। প্রতি শিক্ষাবর্ষে বিডিএস ডিগ্রির জন্য সেগুলোয় ৫৬৫ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। আর ১২টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ ও ১৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে ভর্তি হন ১ হাজার ৩১৫ শিক্ষার্থী। গবেষকদের অন্যতম ও সিএইচআইএনটিএ রিসার্চ বাংলাদেশের পরিচালক মোহাম্মদ মামুন বলেন, একজন শিক্ষার্থী যখন মেডিকেল বা ডেন্টালে ভর্তি হন তখন তার মূল্যায়ন এবং পেশাগত জীবনের মূল্যায়নের মধ্যে তারতম্য বুঝতে পারেন। মেডিকেল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর পেশায় প্রবেশের পর তাদের বেতন পর্যাপ্ত হয় না। সেখানে ডেন্টালের চিকিৎসকরা আরো পিছিয়ে। তাদের সরকারি চাকরির সুযোগও কম। একই সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়েও রয়েছে সুযোগের অভাব। হতাশায় ভোগার আরো অনেক কারণ রয়েছে। যেমন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক সুবিধা এক নয়; রয়েছে পারিবারিক সমস্যা, অসুস্থতা, অধ্যয়নের চাপ।

বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ হতাশার চিত্র অমূলক নয়। তবে মেডিকেলের চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসকের মধ্যে আগের চেয়ে হতাশা কম থাকার কথা। কারণ কাজের সুযোগ এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ বলেন, পেশায় প্রবেশের সুযোগ কম থাকায় ডেন্টাল শিক্ষার্থীরা প্রচুর চাপের মধ্যে থাকেন। আমরা বিষয়টি সমন্বয়ের চেষ্টা করছি। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিটি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে মেন্টাল হেলথের ওপর অনুপ্রেরণামূলক সেশন নিচ্ছি। দন্ত চিকিৎসকদের সুযোগ বৃদ্ধির জন্যও স্ট্যান্ডার্ড সেটআপ করেছি। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বেশকিছু পদ বাড়ানো হয়েছে। আগে উপজেলাগুলোয় ডেন্টালের কনসালট্যান্ট পদ ছিল না। এখন ৪৮৮টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদ সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় একজন করে বাড়ানো হচ্ছে ডেন্টাল সার্জনের পদ। এছাড়া মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটগুলোতেও পদ বাড়ানো হচ্ছে। এগুলো সম্পন্ন হলে ডেন্টালের শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ তুলনামূলক বাড়বে। ডেন্টাল চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসেরও সুযোগ রয়েছে।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0097970962524414