রাজধানীর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদ এবং দুই শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী ও তরুণ কুমার গাঙ্গুলীর পিএইচডি ডিগ্রি ভুয়া। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের তদন্তেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন ও কলেজ শাখার উপপরিচালক কাজী নূরে আলম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ওই অভিযোগ তদন্ত করেন।
কিছু দিন আগে ওই তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের অভিযোগ উঠলে তদন্ত শুরু করে মাউশি। কিন্তু, অভিযুক্তরা তদন্ত কমিটিকে তথ্য না দিয়ে অসহযোগিতার পথে হাঁটেন। সে সময় অভিযুক্তদের সহকর্মী শিক্ষকরা তাদের পিএইচডি গ্রিডি ভুয়া বলে জোর দাবি জানান। অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন ও তৌফিজ আজিজ চৌধুরীর দাবি ছিলো, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলামের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু, তদন্ত কমিটির কাছে ড. জাহিদুল ইসলাম জানান, তিনি জসিম উদ্দীন আহম্মেদ, তৌফিক আজিজ চৌধুরী নামে কাউকে চেনেন না। অপর শিক্ষক তরুণ কুমার গাঙ্গুলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আবুল হোসেনের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন দাবি করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগে আবুল হোসেন নামে কোন শিক্ষকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি একাত্তর টিভিতে প্রচারিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ে। ১১ জন শিক্ষকের অবৈধ নিয়োগের তথ্য পায় তদন্ত কমিটি। শিক্ষক নিবন্ধন সনদ না থাকা সত্ত্বেও ওই ১১ জন শিক্ষককে কলেজে চাকরি দেয়া হয়। তারপর নিয়োগের বৈধতা দিতে ‘যাচাইমূলক’ পরীক্ষা নেয়া হয়, যেটিকে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। পরে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ছাড়া নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার করেন।
এছাড়া সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে প্রতিষ্ঠানের ১১ কোটি টাকা তোলা হলেও সে টাকা খরচের কোনো হিসেব তদন্ত কমিটির কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ড্রেস কেনার জন্য রশিদ ছাড়া অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মেরও প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এরই মধ্যে মাউশি অধিদপ্তরে তদন্ত জমা পড়েছে। অধিদপ্তর থেকে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, গত ১৭ মে অধ্যক্ষ ও অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের কাছে এসব বিষয়ে ব্যাখ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। এর আগে গত ২১ এপ্রিল অধিদপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুই কর্মকর্তা। তাদের প্রতিবেদনে কলেজ ড্রেসের কাপড় ও জুতা বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিনা রশিদে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা করে আদায়ের বিষয়টিও উল্লেখ আছে।
ভুয়া পিএইচডির প্রাথমিক সত্যতা :
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কলেজের অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহমেদ, শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী ও তরুণ কুমার গাঙ্গুলী করোনাতে সবকিছু বন্ধ থাকা অবস্থায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তারা অনলাইনে আমেরিকান ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনির্ভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন বলে দাবি করেন। কলেজের অধ্যক্ষ ও তৌফিক আজিজ চৌধুরী আরও দাবি করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. জাহিদুল ইসলামের অধীনে তারা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু ড. জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার অধীনে আইডিয়াল কলেজের কোন শিক্ষক কখনই পিএইচডি করেন নি এবং আমেরিকান ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনির্ভাসিটির সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। অনলাইনে তিনি কখনও পিএইচডি করান নি এবং আইডিয়াল কলেজের যে তিনজন শিক্ষকের কথা বলা হয়েছে, তাদের সঙ্গে তার কখনও দেখা হয়নি। অপর শিক্ষক তরুণ কুমার গাঙ্গুলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আবুল হোসেনের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন দাবি করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগে আবুল হোসেন নামে কোন শিক্ষকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তদন্তকালে উপস্থিত শিক্ষকদের এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা সবাই পিএইচডি সঠিক নয় বলে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন।
এদিকে শোকজ নোটিশে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, কলেজের অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদ, তৌফিক আজিজ চৌধুরী ও তরুণ কুমার গাঙ্গুলী তদন্তকাজে অসহযোগিতা করেছেন। তারা তাদের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন সম্পর্কিত তথ্য প্রমাণ সরবরাহ করেননি। এতে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
১১ শিক্ষকের অবৈধ নিয়োগ :
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কলেজের অধ্যক্ষ ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে যোগদানের পর ১১ জন শিক্ষক এনটিআরসিএ সনদ ছাড়া নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অধ্যক্ষসহ সব শিক্ষক মৌখিকভাবে স্বীকার করেছেন। নিবন্ধন সনদ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দেয়া বিধিসম্মত হয়নি বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। অধ্যক্ষ ও শিক্ষক নিবন্ধন ছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা জানান, তাদের দক্ষতা যাচাইমূলক পরীক্ষা নেয়া হয়েছে।
রশিদ ছাড়া আদায় হয় ড্রেসের টাকা :
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ছাত্রদের দুইসেট ড্রেসের কাপড় ও এক জোড়া জুতা বাবদ ৩ হাজার ৮০০ টাকা ও ছাত্রীদের দুইসেট ড্রেসের কাপড় ও এক জোড়া জুতা বাবদ ৪ হাজার টাকা দিয়ে কলেজে ভর্তি ফরম নিতে হয়। শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য ভালো হলে আরও ৪০০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কোনো রশিদ দেয়া হয়না। প্রতিবছর ড্রেসের কাপড় ও জুতা কয়েকজন শিক্ষক সরবরাহ করেন। শিক্ষকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে এ টাকা আদায় করা হয়। চলতি বছর ড্রেসের টাকা আদায় কমিটিতে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক ভক্তিময় সরকার, প্রভাষক মো, মিরাজ শরীয় ও শরীরচর্চা শিক্ষ মো. জাহিদুল ইসলাম। শোকজ নোটিশে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, এ বিষয়ে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
১১ কোটি টাকার হিসাব নেই :
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনার সময় দুই বছরে ১১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর কথা সবাই স্বীকার করেছেন। কিন্তু টাকা খরচের কোনো রেকর্ড তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ তার নিজের নামে কলেজে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা খোলেন। আইডিয়াল কলেজের আগে গাজীপুর ও ঢাকার দুইটি কলেজে অধ্যক্ষ থাকার সময়ও তার (জসিম উদ্দিন) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ছিল। লিখিত মতামত ও প্রমাণ সরবরাহের অনুরোধ করা হলেও তিনি (অধ্যক্ষ) কোনও মতামত ও প্রমাণ সরবরাহ করেননি। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
অধ্যক্ষ নীরব :
তবে, এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। অধ্যক্ষের ব্যবহৃত মুঠোফোনে বারবার টেলিফোন করার চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।