নতুন শিক্ষাক্রমে তালগোল, বন্ধ পরীক্ষামূলক পাঠদান - দৈনিকশিক্ষা

নতুন শিক্ষাক্রমে তালগোল, বন্ধ পরীক্ষামূলক পাঠদান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক (পাইলটিং) পাঠদান পাঁচ মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় কিস্তির পাঠ্যবই ছাপাতে না পারায় বছরের মাঝামাঝি এসে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা নিয়ে এক অদ্ভুত রকমের দুর্গতিতে পড়েছে। এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যেই সরকার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা শুরু হবে। কিন্তু তার আগে সেই শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক পড়াশোনা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। এতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা বুঝতে পারছেন না, কোন ‘তরিকায়’ নতুন এই শিক্ষাক্রমের পথচলা শুরু হবে। সবমিলিয়ে ‘গোড়ায় গলদ’ নিয়েই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। বুধবার (১৫ জুন) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক পড়াশোনা নিয়ে যেসব সমস্যা সামনে এসেছে- তা স্বীকারই করতে চাইছে না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তাদের মতে, সমস্যা চিহ্নিত করার জন্যই পরীক্ষামূলক পড়াশোনা চলছে। কিন্তু পরীক্ষামূলক পড়াশোনা বন্ধ- সেটিও মানতে চাইছে না এনসিটিবি। তবু আগামী জানুয়ারি থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পড়াশোনা নতুন শিক্ষাক্রমে চলবে। এজন্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার সারাদেশে ২-৩ দিন করে ৮ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা করছে। প্রসঙ্গত, আগামী শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম, ২০২৪ সালে অষ্টম ও নবম এবং ২০২৫ সালে পুরো মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা করবে শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়াশোনা চলছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক’ পদ্ধতিতে পড়াশোনা চলবে। এতে দশম শ্রেণির আগে কোনো পরীক্ষা থাকছে না। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষেই হাতে-কলমে শিক্ষার্জন করবে।

সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, দেশের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক পড়াশোনা চলছে। এর মধ্যে ৫১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বাকিগুলো কারিগরি ও মাদ্রাসা স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষামূলক পড়াশোনা বন্ধ আছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি চার মাসের জন্য তাদের বই দেয়া হয়েছিল। আর কয়েকদিন পর চার মাস শেষ হলেও পরের ধাপের পাঠ্যবই না আসায় নতুন পড়াশোনা

বন্ধ আছে। গত চার মাস ধরে যা পড়েছে সেগুলো এখন ‘রিভিশন’ দিচ্ছে। সবমিলিয়ে ঈদুল আজহার আগে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূঁইয়া গতকাল বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক পড়াশোনার জন্য সরকার পুরো বছরের বই দেয়নি। মাত্র চার মাসের বই দিয়েছিল। এই চার মাসের পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে বই দিলে সেটি পড়ানো হবে। নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এতে ব্যাপক খুশি। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা অর্জনে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেই সীমাবদ্ধতার সমাধান কীভাবে হবে তা এখনো জানা যায়নি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, পরীক্ষামূলক পড়াশোনার জন্য চার মাসের বই দেয়া হয়েছিল তা এখনো পড়ানোর কথা। পাল্টা প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সেই বইয়ের পড়াশোনা এত তাড়াতাড়ি কীভাবে শেষ হয়?

রাজধানীর গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের শিক্ষক ও নতুন শিক্ষাক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক অশ্রæজিৎ রায় বলেন, আগামী ২২ জুনের মধ্যে পরের ধাপের বই চলে আসার কথা। কিন্তু ওই বইতো এখনো ছাপাই হয়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বই না এলেও কীভাবে পড়াতে হবে তা আমাদের বলে দেয়া হয়েছে। কাজেই পড়াশোনা নিয়ে সমস্যা নেই। তার মতে, নতুন একটি ব্যবস্থা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে ৪-৫ বছর সময় লাগে। এর ফলে এখনই পড়াশোনা বন্ধ বলে হতাশ হওয়ার দরকার নেই।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা শুরু হওয়ার কথা। তার আগে চলতি শিক্ষাবর্ষে সেই শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক পড়াশোনা শুরু হয়। এই পরীক্ষামূলক পড়াশোনায় যেসব সমস্যা চিহ্নিত হবে তার সমাধান করে নতুন শিক্ষাক্রমে যুক্ত করে পাঠ্যবইয়ে ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়ার কথা। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক বোর্ড একসঙ্গে পুরো বছরের জন্য পরীক্ষামূলক বই ছাপিয়ে দিতে পারেনি। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির বই ছাপিয়ে ৬২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে। কথা ছিল, চার মাস পর চলতি জুন মাসে দ্বিতীয় কিস্তির বই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেবে। অক্টোবর থেকে তৃতীয় কিস্তির বই দেয়া হবে। কিন্তু চলতি জুন মাসের ১৫ দিন চলে গেলেও দ্বিতীয় কিস্তির বইই ছাপাতে পারেনি এনসিটিবি।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, পরীক্ষামূলক পড়াশোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তির বই একসঙ্গে ছাপিয়ে স্কুলগুলোতে পাঠানো হবে। আসন্ন ঈদুল আজহার পর শিক্ষার্থীরা এই বই পাবে। নির্ধারিত সময়ে কেন পাঠ্যবই দেয়া যায়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু জটিলতা ছিল।

সরজমিন দেখা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা আগে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে হাতে-কলমে পড়াশোনা করবে, পরে তত্ত্বীয় পড়াশোনায় যাবে। নতুন পাঠ্যবইয়ে ‘ট্রাফিক আইন’ নামে একটি অধ্যায় আছে। সেই অধ্যায়ে ট্রাফিকের কাজকর্ম নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। কিন্তু সেখানেও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার ‘বধ্যভূমি’ নামে আরেকটি অধ্যায় আছে। ‘বধ্যভূমি’র অভিজ্ঞতা নিতে হলে শিক্ষার্থীদের যেতে হবে কোনো না কোনো বধ্যভূমিতে। স্কুল থেকে বধ্যভূমি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের খরচ কে দেবে, সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি হিন্দু ধর্মে ‘পূজাপাঠ’ নামের অধ্যায়ে অভিজ্ঞতা নিতে হলে শিক্ষার্থীদের যেতে হবে কোনো মন্দিরে পুরোহিতের কাছে। প্রশ্ন উঠেছে, একটি ক্লাসের বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীকে কীভাবে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুরোহিতের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা শিক্ষাদান করানো যাবে?

রাজধানীর গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক গতকাল বলেন, ট্রাফিকের কাজকর্মের অভিজ্ঞতা শেখানোর জন্য শিক্ষার্থীদের নিউমার্কেটের মোড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ শিক্ষার্থীদের সেই অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা দিতে রাজি হয়নি। পুলিশ শিক্ষককে বলেছে, এই মোড়ে এমনিতেই যানজট লেগে থাকে। এখন অভিজ্ঞতার শিক্ষা দিতে গেলে যানজট আরো বাড়বে। এসব এখানে সম্ভব নয়, আপনারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলে ফিরে যান। ওই শিক্ষক নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, পুলিশের কাছ থেকে বিফল হয়ে ল্যাবরেটরি স্কুলে ফিরে রাস্তায় দেখা ঘটনাগুলো শিক্ষার্থীদের বলেছি। এতে তারা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে কতটুকু অভিজ্ঞ হয়েছে তা শুধু শিক্ষার্থীরাই বলতে পারবে।

অন্যদিকে ঢাকার বাইরের একটি স্কুলের অবস্থা আরো করুণ দশায় পড়েছে। ওই স্কুলের নাম এবং শিক্ষকের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক জানান, শিক্ষার্থীদের কী অভিজ্ঞতা শিক্ষার পাঠ দেব তা শিক্ষক হিসেবে নিজেই বুঝতে পারছি না। তবে মুখস্থ বিদ্যা না থাকায় শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমে আনন্দিত বলে জানান ওই শিক্ষক। ওই শিক্ষকের মতে, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না দিলে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা কখনোই দিতে পারবেন না।

জানতে চাইলে শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির গতকাল বলেন, নানা তথ্য ঘেঁটে মনে হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে সমন্বয় ঘটানো কঠিন হবে। এজন্য তড়িঘড়ি না করে অন্তত আরো এক বছর সময় নিয়ে পরীক্ষামূলক পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রস্তুত করে তবেই চূড়ান্ত বাস্তবায়নে যাওয়া উচিত। নতুবা নতুন শিক্ষাক্রমে গ্রামগঞ্জে সমান সুযোগ তৈরি হবে না। এর ফলে শিক্ষার মানেরও উন্নতি ঘটবে না।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ নতুন শিক্ষাক্রমকে যুগোপযোগী উল্লেখ করে বলেন, নতুন পদ্ধতির পড়াশোনায় শিক্ষার্থীরা খুব আনন্দ পাচ্ছে। এবার শিক্ষকরাও যাতে আনন্দ পান সেজন্য আগামী শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরুর আগেই অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার সারাদেশে ৮ লাখ শিক্ষককে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ দিতে চায়। এজন্য প্রথমে সারাদেশ থেকে কিছু শিক্ষককে ঢাকায় এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘মাস্টার ট্রেইনার’ তৈরি করা হবে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় সাধারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। আগামী সপ্তাহে একটি বৈঠকে প্রশিক্ষণ শুরুর দিনক্ষণ ঠিক করা হবে বলে তিনি জানান।

যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ - dainik shiksha বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034310817718506