নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। বয়সে প্রবীণ, নিজের ও পরিবারের কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত এবং দক্ষ হাতে মন্ত্রণালয় চালাতে না পারা—মোটাদাগে এই তিন কারণে বিদায়ি মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য বাদ পড়েছেন। যেসব কারণে মন্ত্রিসভায় রদবদল হয়েছে, সেগুলোর অন্যতম গত পাঁচ-দশ বছরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কার্যক্রমের সঙ্গে বিতর্ক জুড়ে যাওয়া। মূলত নির্বাচনের পর থেকেই মন্ত্রিসভায় কে বা কারা আসছেন এবং বাদ পড়ছেন—এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। তবে এ ক্ষেত্রে বেশি লক্ষণীয় ছিল শিক্ষামন্ত্রী পরিবর্তনের ইস্যুটি। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীকে মন্ত্রিসভায় না রাখার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বেশ কিছু সমালোচনামুখর দাবি উঠতে দেখা যায়। পরে যখন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে পরিবর্তন করে ডা. দীপু মনিকে দেওয়া হলো তখন অনেকের মধ্যেই একধরনের উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে। সর্বসাধারণের মনে একটি প্রত্যাশা জেগেছে, হয়তো শিক্ষাব্যবস্থার যথাযথ কাঠামো পাবে নতুন শিক্ষামন্ত্রীর হাত ধরে। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দৃশ্যমান বেশ কিছু সংকট সৃষ্টি হলেও সে বিষয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগ ও ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এ কারণেই নতুন শিক্ষামন্ত্রীকে শিক্ষার নানা সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে এবং সেগুলো সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার প্রথম থেকেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টায় ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই সরকার সফল হয়েছে। তবে বেশ কিছু মারাত্মক সমস্যা ও বিতর্কিত ইস্যু পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে আক্রান্ত করেছে। বিভিন্ন ধরনের সংকটের মধ্য থেকে বাছাইকৃত কয়েকটি সমস্যা নিয়ে নতুন শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথমত, শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনা করে পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে প্রধানমন্ত্রী বারবার জোরালো নির্দেশনা দিলেও তা কখনোই মানতে দেখা যায়নি। এমনকি শিশুর স্কুলব্যাগ তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না বলে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টের রায় হওয়া সত্ত্বেও পঞ্চম শ্রেণিতে যে শিশুটিকে ছয়টি বই পড়তে হয়েছে, ২০১৮ সালের পর থেকে তাকে ১৪টি বই পড়ে পরীক্ষায় বসতে হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ নির্দেশনা ও সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। রমরমা কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে তারা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য স্কুল, কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠানে দিনে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। কোনো কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা যাবে না। বাস্তবে এ ধরনের নির্দেশনাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এগুলো প্রকৃতপক্ষে অবাধে কোচিং বাণিজ্য করার জন্য শিক্ষকদের লাইসেন্স প্রদান করা হয়। কারণ প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক রমরমা কোচিং বাণিজ্যের সুযোগ পেয়ে যান।
তৃতীয়ত, প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো নৈতিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, প্রবণতা ও আগ্রহ অনুসারে তাকে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা এবং পরবর্তী স্তরে শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষই তার সন্তানকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য থাকে। তাহলে শিক্ষার্থীদের কেন টিফিনের ব্যবস্থা না করে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ধরে রাখা হয়? একটি দীর্ঘ সময়সূচি শিশু নির্যাতনের শামিল কি না এ প্রশ্নটি ন্যায্যভাবেই আমাদের সামনে এসেছে বারবার।
চতুর্থত, সচেতন ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে না। অন্যদিকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকরা নিজেরাই প্রতিযোগিতায় নেমে যান। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়েও যথেষ্ট যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক রয়েছেন।
পঞ্চমত, প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা এবং চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মেধাবীদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। নিশ্চিত প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি জানা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষকে পরীক্ষা বাতিল করতে দেখা যায়নি।
ষষ্ঠত, বর্তমান সময়ে প্লে কিংবা নার্সারি শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে শিক্ষার্থীদের এমনিতেই মানসিক চাপ বহন করতে হয়। বিশেষ করে পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে যেভাবে মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয় তাতে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খুব বেশি ভাবতে দেখা যায়নি। মূলত শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। প্রায়ই পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্ন পদ্ধতি পাল্টানো হয়।
সপ্তমত, গত বছরের ৯ জুন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জিপিএ ৫ কেনাবেচা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেখে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী পরিশ্রম না করেই টাকার বিনিময়ে কিনছে জিপিএ ৫-এর সনদ—এমন খবরে আমরা সবাই হতাশ হই। উল্লিখিত প্রতিবেদনসূত্রে রাজধানীর কয়েকটি স্কুল-কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢাকা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের জিপিএ ৫ পাইয়ে দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, টাকার বিনিময়ে ফেল করা শিক্ষার্থীকেও পাস করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত কিংবা আইনানুগ ব্যবস্থা আদৌ হয়েছে কি না সেটি আমার জানা নেই। শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে আমরা সবাই কমবেশি ভাবি। এমনকি এ বিষয়ে লেখালেখি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম প্রতিনিয়তই চলছে। কিন্তু নানা ক্ষেত্রে শিক্ষার যে বেহাল দশার উদ্ভব হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া কোনো এক অজানা কারণে সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার চরম ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হতে আর বাকি থাকবে না। কাজেই নতুন শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সংকটগুলো চিহ্নিত করে একটি সুন্দর কাঠামোগত শিক্ষাব্যবস্থা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য উপহার দেবেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়