নদীমাতৃক দেশে নদীই বেশি অবহেলিত - দৈনিকশিক্ষা

নদীমাতৃক দেশে নদীই বেশি অবহেলিত

সাধন সরকার |

১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। নদীর জীবন আছে। জীবন আছে বলেই এই নদী আমাদের সেচ ব্যবস্থা, যাতায়াত, মৎস্য উৎপাদন, পানি সরবরাহ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। সময়ের পরিক্রমায় নদীর প্রাকৃতিক গঠনগত পরিবর্তন, কম পানি প্রাপ্তি, দখল, দূষণ আর ভরাটের কারণে দেশের নদ-নদীগুলোর আজ অবস্থা বেহাল। দখল-দূষণের সঙ্গে পলিচাপা পড়ে দম বন্ধ হয়ে নদীগুলো মারা যাচ্ছে! দেশের কোনো কোনো নদী শেষ চিহ্নটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে! বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে তখনো আমাদের জানা নেই, আমাদের দেশে আসলে নদীর সংখ্যা কতো?

এ ব্যাপারে সরকারি বিভিন্ন বই ও প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। এসব ভিন্ন ভিন্ন তথ্য মূলত নদী রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিকতার অভাবকেই তুলে ধরে! যদিও সম্প্রতি জাতীয় নদী কমিশন থেকে জানানো হয়েছে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৭৭০-এর কাছাকাছি। কোনো কোনো নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে আছে, অথচ বাস্তবে নেই! অনেকের লোভ-লালসার ছাপ পড়েছে নদীর ওপর। নদী দখল করে অনেকে মাছ চাষ করছেন, বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে নদীর ওপর, নদীর জমি দখল করে অনেকে নেতা বনে যাচ্ছে। আবার অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যের লাইন জুড়ে দিয়েছে নদীর সঙ্গে। অনেক স্থানে গৃহস্থালির বর্জ্যের লাইনও জুড়ে দেয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো স্থানে শহরের সিটি করপোরেশনের ময়লা-আবর্জনা গিয়ে পড়ছে পাশের নদীতে। শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। দেখা যায়, নদ-নদী দূষণ-দখল আর ভরাটের সঙ্গে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। বিভিন্ন সময় তারা দলের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নদ-নদীগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে! নদী দখল-দূষণকারীরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে না। 

নদীও কথা বলে। নদীরও সুখ-দুঃখ আছে। যুগের পর যুগ নদ-নদীগুলো আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রেখেছে। নদীগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ করে চলেছে। নদীতে বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে একটার পর একটা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, উৎসমুখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ছোট ছোট খাল-বিল, শাখানদী, উপনদীগুলো ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হচ্ছে। ফলে বড় বড় নদ-নদীতে পানি সরবরাহের উৎসে এখন টান পড়েছে। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বালুখেকোরা নদ-নদীর সর্বনাশ করছে সবচেয়ে বেশি। মনে রাখতে হবে, নদীগুলো আমাদের সম্পদ, সৌন্দর্য। নদ-নদীর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। আমরা যদি চোখ বন্ধ করে বিশ বছর আগে এলাকার বা স্থানীয় নদ-নদীর কথা চিন্তা করি তাহলে কি নদ-নদীর এমন মরণদশার চিত্র দেখতে পাবো? নিশ্চয় না। গত দুই-তিন দশকে নদী-নদীগুলো তাদের প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সরকার বছরের পর বছর নদ-নদী বাঁচাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সেসব অর্থের যথার্থ ব্যবহার হচ্ছে না। সঠিক সময়ে ও পরিকল্পনামাফিক নদীগুলো খনন করা হচ্ছে না। নদী খনন কাজে দক্ষতার অভাবে নদ-নদীর পলি অপসারণ করার পরপরই নদ-নদীগুলো আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পলি অপসারণ করেই ওই মাটি নদীর তীরেই রাখা হচ্ছে, ফলে সেই মাটি আবার নদীতেই এসে পড়ছে। 

এভাবে বছরের পর বছর নদীতে পলি ও বালু পড়ে ডুবোচরের সংখ্যা বাড়ছে। নদী খনন কাজে জবাবদিহি ও পরিকল্পনার অভাবে নদ-নদীগুলোর আজ এমন বেহাল দশা। তথ্য মতে, বেসরকারি হিসাবে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ২৩০টির মতো। নৌপথ ক্রমাগত কমতে কমতে এখন নেমে এসেছে চার হাজার কিলোমিটারে (যদিও পানির মৌসুমে নৌপথ দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার)। অথচ ব্রিটিশ শাসনামলে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার। পাকিস্তানি আমলে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার। 

আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে নৌপথের সুবিধা অনেক। নৌপথে পরিবহন খরচ কম। নৌপথ জ্বালিানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোনো কোনো সময় নদীর জমি অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ বা বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সময় নদীর তীরের জমি বেদখল হয়ে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। নদীর ওপর এমনসব অত্যাচার চলতে থাকলে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশের বদলে ‘নদীমৃত্যুর দেশে’ পরিণত হবে! আগে বাংলাদেশে নদী রক্ষায় এতো এতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছিলো না, অথচ তখন নদ-নদীর দখল-দূষণ-ভরাট কম হতো। আর এখন নদী রক্ষায় বহু প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও নদ-নদী রক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই সময় এসেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরো লোকবল, সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজনীয় স্বাধীন ক্ষমতা দেয়ার।

এ ছাড়া নদী বিষয়ে আলাদা ট্রাইব্যুনাল করলে তা নদ-নদী রক্ষার্থে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। নদী পুলিশও গঠন করা যেতে পারে। সম্প্রতি সরকার নদ-নদী দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। সে প্রেক্ষাপটে নদী দখল-দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন কিছু নয়। নদ-নদী তথা প্রকৃতির ওপর বছরের পর বছর অত্যাচার করে কোনো সভ্যতা টিকেনি। তাই আমাদের সম্পদ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নদ-নদীগুলোকে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে। নদীর দখল-দূষণ রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। 

লেখক: সাধন সরকার,  শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

 

ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034520626068115