নম্বরপত্র ঘষামাজা করে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষক নিয়োগ - দৈনিকশিক্ষা

নম্বরপত্র ঘষামাজা করে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষক নিয়োগ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পছন্দের প্রার্থীদের শিক্ষক নিয়োগ দিতে পরীক্ষার ফলাফলের নম্বরপত্র (ট্যাবুলেশন শিট) কাটাছেঁড়া করা হয়েছে । এমনকি  ট্যাবুলেশন শিটে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর নেই,  এমন প্রার্থীও নিয়োগ পেয়েছেন।  রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে গত কয়েক বছর অন্তত ১৪ জন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এরকম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। রোববার (১৭ জানুয়ারি) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মোশতাক আহমেদ। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ৭৪ জন শিক্ষক তথ্যপ্রমাণসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদপ্তর ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন।  অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করছে ডিআইএ।  তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন শিক্ষা পরিদর্শক টুটুল কুমার নাগ, মো. হেমায়েত উদ্দীন, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক রাকিবুল হাসান, নিরীক্ষা কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান ও সুলতান আহমেদ। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটির একজন বলেন, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এ ছাড়া আর্থিক ক্ষেত্রেও কিছু অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন তাঁরা। প্রাপ্ত তথ্য গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন। 

রাজধানীর শান্তিনগরে অবস্থিত হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ১০ হাজার। মোট ১৫২ জন শিক্ষক এবং ৭২ জন কর্মচারী। অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন আব্দুল জব্বার মিয়া।  সাবেক অধ্যক্ষ আবু বকর চৌধুরী সম্প্রতি মারা গেছেন।  বর্তমানে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন অধ্যাপক।  এর আগে সভাপতি ছিলেন এস এম বাহালুল মজনুন নামের একজন। 

বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আব্দুল জব্বার মিয়া বলেন, অনেক অভিযোগ ভিত্তিহীন। ডিআইএ বিষয়টি তদন্ত করছে। তারা রেকর্ডপত্র নিয়ে গেছে তাই এখনই তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চান না।

শিক্ষক নিয়োগে যত অভিযোগ

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে কলেজটির হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তিনজন প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু নিয়োগ দেয়া হয় ৬ জনকে। ট্যাবুলেশন শিটে একজনের নম্বর কাটাছেঁড়া করা হয়েছে।  মোট নম্বর ২৩ কেটে করা হয়েছে ৩০।  আরেকজন হিসাববিজ্ঞানের এনটিআরসি সনদের বদলে কারিগরির সনদ জমা দিয়েছেন। 

গণিত বিভাগে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগ পরীক্ষার ট্যাবুলেশন শিটে দেখা যায়, প্রভাষক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত নম্বর ছিল ২৫ নম্বর। কাটাছেঁড়া করে নম্বর ৩২ করা হয়েছে।  
একই বিভাগে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে আরেকটি নিয়োগ পরীক্ষা হয়।  বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক শূন্য পদে ২ জন প্রভাষক নিয়োগের কথা ছিল।  নিয়োগ কমিটির সুপারিশে প্রথম স্থান অধিকারী মো. মাহফুজুর রহমান ও দ্বিতীয় হওয়া নন্দিতা হীরাকে নিয়োগও দেয়া হয়েছে। তৃতীয় হয়েছিলেন মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া; চতুর্থ রফিকুল ইসলাম।  তাঁদের বাদ দিয়ে এমন একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ট্যাবুলেশন শিটে যাঁর নামের ঘরে প্রাপ্ত নাম্বার নেই। 

ব্যবস্থাপনা বিভাগে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগ পাওয়া একজনের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। ট্যাবুলেশন শিটে কাটাছেঁড়া করে তাকে নিয়োগ পরীক্ষায় তৃতীয় বানানো হয়েছে।  আরেকজনের যথাযথ শিক্ষক সনদ নেই।  তিনি নিয়োগ পেয়েছেন ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগে।  কিন্তু জমা দিয়েছেন কারিগরি নিবন্ধনের প্রত্যায়নপত্র ।

অর্থনীতি বিভাগে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে নিয়োগ পাওয়া দুজনের ট্যাবুলেশন শিটে নামের ঘরে প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ নেই।  আর নম্বর কাটাছেঁড়া করা হয়েছে আরেকজনের।  তাঁর মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ৭ কেটে ১০ করা হয়েছে।  প্রাণ রসায়ন বিভাগের কাজি রায়হান রাফি ও শারমিন সুলতানা যৌথভাবে লিখিত পরীক্ষায় ১৮ নম্বর পেয়েছিলেন।  যাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিনি লিখিত পরীক্ষায় মাত্র ৯ নম্বর পেয়েছিলেন। রায়হানের নাম বসানো হয়েছে পঞ্চম স্থানে। 

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভায় সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) খুলতে সাতজন শিক্ষক  নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয় । নিয়োগ পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে প্রার্থীদের প্যানেল করা হয়, তাতে নাম না  থাকা একজনকেও গত অক্টোবরে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিবিএ প্রফেশনাল বিভাগে ইংরেজির প্রভাষক নিয়োগ পরীক্ষায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রার্থীকে বাদ দিয়ে চতুর্থ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 

ভুয়া ভাউচারে অর্থ নয়ছয়

 হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে বিভিন্ন কাজের জন্য ভুয়া ভাউচার বানিয়ে অর্থের নয়ছয় করার অভিযোগও আছে । বিভিন্ন কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম দেখানো হয়েছে।  কিন্তু ভাউচারে একই মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।  আবার হাতের লেখাও হুবহু মিলে যায়। কোন কোন ভাউচারে আবার তারিখ লেখা নেই।  অভিযোগকারী শিক্ষকেরা এরকম কিছু ভাউচারের অনুলিপি অভিযোগপত্রের সঙ্গে জমা দিয়েছেন। 

স্বপ্ন পরিবহন (প্রা.) লিমিটেডের প্যাডে একটি ভাউচারে ৪১টি বাস ভাড়ার (বনভোজনের) জন্য বিল ৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা।  পিকনিক স্পট ভাড়ার (সাড়ে ৩ লাখ টাকা)বিল করা হয়েছে ঢাকা পিকনিক রিসোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্যাডে।  তাতে থাকা স্বপ্ন পরিবহনের প্যাডের হাতের লেখার সঙ্গে মিলে যায়।  আবার ঢাকা সাউন্ড সিস্টেমের প্যাডে সাউন্ড সিস্টেমের সরঞ্জম ও শিল্পীদের সম্মানী (২ লাখ ৬৭ হাজার), শান্তিনগরের অনীক হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট থেকে বিভিন্ন খাবারের জন্য ১৫ হাজার টাকা। মহানগর মাংস বিতান থেকে খাসির মাংস কিনতে ৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।  রাজধানী মোরগ বিতান থেকে মুরগি কিনতে ১ লাখ ২৬ হাজর ৫০০ টাকা। করিম মনিহারি স্টোর থেকে থেকে কেনাকাটায় ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। হানিফ ডেকোরেটার্সের বিল ৬৮ হাজার হাজার ৯৮০ টাকা দেখানো হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি বিল-ভাউচারের হাতের লেখা একই। এর মধ্যে খিলগাঁওয়ের সিপাহিবাগের হানিফ ডেকোরেটার্স, মাদারটেকের করিম মনিহারি স্টোর, নয়াপল্টনের টাকা সাউন্ড সিস্টেম নন্দীপাড়ার রাজধানী মোরগ বিতান এবং স্বপ্ন পরিবগনের প্যাডে একই মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। ফোন দিলে ওই নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। 

এ ছাড়া কুমিল্লা স্টিল থেকে ৫৭ হাজার টাকা দিয়ে তিনটি আলমারি এবং আলী ফার্নিচার স্মার্ট থেকে ৬২৫টি বেঞ্ছ রং করতে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু দুটি বিলের হাতের লেখায় মিল দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানটির বিলেও অসামঞ্জস্য দেখেছে ডিআইএর তদন্ত কমিটি। 

জানতে চাইলে প্রায় ৩৮ বছর বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা প্রবীণ শিক্ষক বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল-কলেজে নানা মাত্রায় দুর্নীতি হয়। এ জন্য তাঁর পরামর্শ হলো সরকারি কর্ম-কমিশনের আদলে 'শিক্ষা সার্ভিস কমিশন' গঠন করা। এই কমিশিনের মাধ্যমে সব নিয়োগ বাস্তবায়ন করা, এমপিভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজও বদলির ব্যবস্থা রাখা এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালনার ব্যবস্থা করা। তাহলে ৮০ শতাংশ দুর্নীতি এমনিতেই কমে যাবে। 

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030229091644287