আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিভিন্ন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ১০টি বিষয় যুক্ত করারি পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এর মধ্যে তিনটি বিষয় শিক্ষার উন্নতির জন্য।
১. জ্ঞানভিত্তিক দেশ : প্রথম যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছিল তখন অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিল এবং বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি। কিন্তু এখন মোটামুটি সবাই বিষয়টি গ্রহণ করেছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে উদ্যোগ নেওয়ার কারণে অনেক কিছু ঘটেছে, যেটি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ঘটা সম্ভব ছিল না। যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয় তখন দেশের মানুষের কথা আলাদাভাবে বলা হয় না; কিন্তু যদি এর পরের ধাপ হিসেবে আমরা জ্ঞানভিত্তিক দেশের কথা বলি তখন কিন্তু আমরা দেশের মানুষের কথা বলি। আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সব মিলিয়ে চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি। যদি তাদের সবাইকে ঠিকভাবে লেখাপড়া করানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে সে রকম দেশ আর কয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে? আমরা সবাই দেখেছি, এ দেশের একেবারে সাধারণ মানুষটিও কিন্তু লেখাপড়ার গুরুত্ব ধরতে পেরেছে। লেখাপড়ার মান নিয়ে আমরা এখনো সন্তুষ্ট নই। কিন্তু যদি লেখাপড়ার মানটুকু বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে জোর দিয়ে বলা যাবে আমাদের দেশটিকে জ্ঞানভিত্তিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সব উপাদানই আছে।
দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এখনো এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের শরীরের ঘাম। তাদের পাশে যদি মেধা নিয়ে নতুন প্রজন্ম দাঁড়াতে শুরু করে, তাহলেই আমরা জ্ঞানভিত্তিক দেশের স্বপ্নে পা দিতে শুরু করব। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আশা করতেই পারি তারা আমাদের দেশকে জ্ঞানভিত্তিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাবে।
২. শিক্ষায় জিডিপির ৪ শতাংশ : বাংলাদেশ ডাকার সম্মেলনে অঙ্গীকার করেছিল যে তারা দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ খরচ করবে। এখন বাংলাদেশ খরচ করছে ২.৫ শতাংশ থেকেও কম। আমি সব সময়েই বলে থাকি লেখাপড়ার পেছনে এত কম টাকা খরচ করে পৃথিবীর আর কোনো দেশ এত ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করানোর কথা চিন্তাও করতে পারবে না। আমরা ইচ্ছা করলে তো দাবি করতেই পারি যে যতটুকু অঙ্গীকার করা হয়েছিল ততটুকু খরচ করতে হবে; কিন্তু তাহলে হয়তো আমাদের দাবিটি কেউ বিশ্বাস করবে না। এই মুহূর্তে যেটুকু খরচ করা হচ্ছে তার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি কেমন করে চাই?
তাই আমার মনে হয়, আমরা আপাতত নির্বাচনী ইশতেহারের জন্য জিডিপির ৪ শতাংশ চাইতে পারি। যাঁরা বাজেট করেন তাঁদের বিশ্বাস করতে হবে লেখাপড়ার পেছনে যদি এক টাকাও বাড়তি খরচ করা হয়, তাহলে সেটিরও একটি ফল পাওয়া যায়। এর কারণ লেখাপড়ার পেছনে যে টাকা খরচ করা হয় সেটি মোটেও খরচ নয়, সেটি হচ্ছে বিনিয়োগ।
৩. সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা : কেন সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া উচিত, সেটি নিশ্চয়ই নতুন করে কাউকে বোঝাতে হবে না। ভর্তি পরীক্ষার নামে ছেলে-মেয়েদের এমন একটি নিষ্ঠুরতার ভেতর দিয়ে নেওয়া হয়, যেটি রীতিমতো অবিশ্বাস্য। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেটি লক্ষ করেছেন এবং একাধিকবার সব উপাচার্যকে ডেকে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন। গত বছর সেটি নেওয়া সম্ভব হয়নি, আমি ভেবেছিলাম এ বছর নিশ্চয়ই সেটি হবে; কিন্তু আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি যে এই বছরও কেউ এটি নিয়ে কথা বলছেন না! সত্যি কথা বলতে কি, এই বছর অবস্থা আগের থেকে খারাপ। আগে যে পরীক্ষাটি একবার নেওয়া হয়েছে, প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কারণে এবার সেই পরীক্ষা দুইবার নিতে হয়েছে। কেমন করে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের রক্ষা করব জানি না। কিন্তু আমি নিশ্চিত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার অঙ্গীকার এ দেশের তরুণ প্রজন্ম ও তাদের মা-বাবা এক বাক্যে লুফে নেবেন। কাজেই নির্বাচনী ইশতেহারে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার অঙ্গীকার করে তরুণ প্রজন্মকে খুব সহজে উৎসাহী করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
৪. মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ : সবার প্রথমে আমি চাইব সব রাজনৈতিক দল যেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে খুবই স্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলে। এ দেশে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের কথা বলে রাজাকার কমান্ডারদের একবার ক্ষমতায় আসতে দেখে আমি ‘মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ’ কথাটির ব্যাপারে অনেক স্পর্শকাতর হয়ে গেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর মুখ থেকে এই কথাটি খুব স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হতে না শুনলে আমি স্বস্তি অনুভব করি না। একাত্তর সালে আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি যারা রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার তারাই একদিন এ দেশের মন্ত্রী হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে আর কখনো যেন এ রকম কিছু ঘটতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ গড়ে তোলা হবে বলা হলে আসলে অনেক কিছু বলা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝে যাই আমরা সব ধর্ম, সব বর্ণ ও সমাজের সব স্তরের মানুষকে নিয়ে একটি আধুনিক দেশ গড়ে তোলার কথা বলছি। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাই আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক দেশের কথা বলছি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলছি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছি। সে জন্য এই তালিকার প্রথম বিষয়টি সব সময়েই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ।
৫. বঙ্গবন্ধু : বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় কোনটি জিজ্ঞেস করা হলে অনেক ঘটনার কথা উঠে আসবে, যার একটি হচ্ছে ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসন দেওয়া। ১৯৭৫ সালে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয়ে গেছে; কিন্তু তাঁর স্মৃতিটুকুও যেন এ দেশে না থাকে তার জন্য সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে। রেডিও-টেলিভিশনে তাঁর নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কথা না জেনে। অথচ এই মানুষটি এবং বাংলাদেশ আসলে সমার্থক। আমাদের অনেক বড় সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধু এ দেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যদি তাঁর জন্ম না হতো আমরা সম্ভবত বাংলাদেশটিকে পেতাম না। বেঁচে থাকতে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন; কিন্তু এখন তিনি আর কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নন। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, সারা বাংলাদেশের সব মানুষের নেতা।
কাজেই আমি চাই এ দেশের সব রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্বীকার করবে। অকৃতজ্ঞ মানুষকে আমরা ঘেন্না করি, তার থেকে শত হাত দূরে থাকি। ঠিক একই কারণে অকৃতজ্ঞ রাজনৈতিক দলের জন্য সেটি অন্য রকম হবে কেন? তাদের কাছে অন্যরা কে কী আশা করে আমি জানি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি অকৃতজ্ঞ রাজনৈতিক দলের কাছে কিছুই আশা করতে পারি না।
৬. অসাম্প্রদায়িক : বাংলাদেশ গত ১০ বছরে অনেক অগ্রসর হয়েছে। সংখ্যা দিয়ে বিচার করতে চাইলে বলা যায় জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ, মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৭৫২ ডলার, দারিদ্র্য হার কমে হয়েছে ২২ শতাংশ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তৈরি করা পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়ে গেছে ৬০ শতাংশ। বিদেশি পত্রপত্রিকাগুলো বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা দেখানোর জন্য খুবই ব্যস্ত। তারা প্রায় সময়েই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে রগরগে চটুল তথ্য দিয়ে হেডলাইন করে থাকে। সে রকম একটি সাপ্তাহিকী দি ইকোনমিস্ট পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই দেশের উন্নয়ন দেখে আমরা সবাই খুশি। আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে চাইলেই আমরা অনেক দ্রুত দেশকে উন্নত করে ফেলতে পারব।
কিন্তু আমাদের সব আনন্দ ও উৎসাহ মাঝেমধ্যেই ছোট একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা দেখে পুরোপুরি ম্লান হয়ে যায়। যত সময় যাবে আমাদের হৃদয়ের প্রসারতা তত বাড়ার কথা, আমাদের তত উদার হওয়ার কথা। কিন্তু যখন দেখি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা কমেনি বরং বেড়েছে তখন আমরা খুবই অসহায় বোধ করি। আমি সব সময়েই বলে এসেছি একটি দেশ ভালো চলছে না খারাপ চলছে সেটি জানার জন্য বড় বড় গবেষণা করতে হয় না, সেমিনার কিংবা গোলটেবিল বৈঠক করতে হয় না, দেশের একজন সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী মানুষকে জিজ্ঞেস করতে হয়। তারা যদি বলে দেশটি ভালো চলছে, তাহলে বুঝতে হবে দেশটি আসলেই ভালো চলছে। যদি তারা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তাহলে বুঝতে হবে দেশটি ভালো চলছে না। এ দেশে এখনো মানুষে মানুষে বিভাজন রয়ে গেছে। বেশ কয়েক বছর আগে আমি দলিত শিশুদের একটি সমাবেশে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি ফুটফুটে শিশুদের কাছে শুনেছিলাম তারা সেই এলাকায় অস্পৃশ্য। পানি খাওয়ার জন্য একটি গ্লাসকে পর্যন্ত তারা স্পর্শ করতে পারে না।
কাজেই আমি চাইব, নির্বাচনী ইশতেহারে খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে যে দেশের সব মানুষের ভেতর থেকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা দূর করে সবাইকে নিয়ে আধুনিক একটি বাংলাদেশ তৈরি করা হবে।
৭. নারী-পুরুষ সমতা : আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি কী, আমি সব সময়েই তার উত্তরে বলে থাকি যে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এখানে সব ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েরা সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে বরং মেয়েদের সংখ্যা একটু বেশি, মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের লেখাপড়ার মান ভালো। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যখন বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, সেখানে মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি। মেয়েদের আন্তর্জাতিক খেলায়ও মেয়েরা অনেক ভালো করছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে দেখা যায় ছেলেদের সংখ্যা থেকে মেয়েদের সংখ্যা কম। কারণ তখন মা-বাবার ধারণা হয় ভালো একটি পাত্র দেখে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলা দরকার। মেয়েরা যে শুধু লেখাপড়ার সব জায়গায় আছে তা নয়, গার্মেন্ট শ্রমিক প্রায় সবাই মেয়ে এবং তারা আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে ক্যারিয়ার বলে একটি নিষ্ঠুর শব্দ আছে। যেকোনো পর্যায়েই এই ক্যারিয়ারের প্রতিযোগিতায় পুরুষের কাছে মেয়েরা হেরে যায়। কারণ যখন ক্যারিয়ার গড়ার সময়, সেটি সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়, সন্তানকে বড় করার সময়। পুরুষ মানুষ অনেক কিছু করতে পারলেও সন্তান জন্ম দিতে পারে না, সন্তানের মা হতে পারে না।
কাজেই রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে নারীদের এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। যেখানে মেয়েরা কাজ করে, সেখানে চমৎকার ডেকেয়ার গড়ে তুলতে পারে। সেটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিই হোক আর বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক। যদি মায়েরা জানেন তাঁর শিশু সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার একটি জায়গা আছে, তাহলে তাঁদের জীবনটিই অন্য রকম হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনের সময় ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বলে একটি শব্দ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে, তাহলে পুরুষ ও নারীর ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ব্যাপারে কেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না? মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার বেলায় বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে কেন এগিয়ে থাকবে না?
কাজেই নির্বাচনী ইশতেহারে আমি নারী-পুরুষের মাঝে সমতা আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝ থেকে এ রকম একটি অঙ্গীকার দেখতে চাই।
৮. সাইকেল লেন : বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম। বিশেষ করে যারা ঢাকা শহরের বাইরে থাকে তারা যদি ঢাকায় এসে একবার ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রণাটি অনুভব করে, তাহলে সাধারণত তার ঢাকা আসার সাধ জন্মের মতো মিটে যায়। ঢাকা শহরে নানা মিটিংয়ের জন্য আমাকে প্রায়ই আসতে হয়, আমি একটি বিচিত্র বিষয় আবিষ্কার করেছি। ঢাকা শহরে কোথাও আমি সময়মতো যেতে পারি না।
বেশি সময় হাতে নিয়ে রওনা দেওয়ার পরও ঠিক সময় পৌঁছতে পারি না কিংবা বেশি সময় হাতে নিয়ে রওনা দেওয়ার কারণে অনেক আগে পৌঁছে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে হয়। সোজা কথায় বলা যায়, কতটুকু দূরত্ব কত সময়ে পৌঁছানো যাবে সে দুটির মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে ঢাকার মানুষজনের যে কী পরিমাণ সময় নষ্ট হয় তার কোনো হিসাব নেই। সেই সময়টিকে যদি টাকা দিয়ে বিবেচনা করা যায়, আমার ধারণা তাহলে আমরা প্রতি মাসে একটি করে পদ্মা সেতু তৈরি করে ফেলতে পারব।
আমার ধারণা, এর একটি খুব সহজ সমাধান আছে, সেটি হচ্ছে সাইকেলে যাতায়াত করা। আমাদের নতুন একটি আধুনিক প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে সাইকেলে যেতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। শুধু তা-ই নয়, স্কুলের অনেক ছেলে-মেয়েও সাইকেলে করে স্কুলে যাবে। এখন যেতে পারে না শুধু একটি কারণে, সেটি হচ্ছে ব্যাপারটি মোটেও নিরাপদ নয়। যে রাস্তায় দৈত্যের মতো বড় বড় বাস-ট্রাক একটির সঙ্গে আরেকটি প্রতিযোগিতা করে ছুটে যাচ্ছে, সেই রাস্তায় কে সাইকেলে যেতে সাহস পাবে? কিন্তু যদি রাস্তার এক পাশে ছোট একটি লেন তৈরি করে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হয়, তাহলে সবাই সেই পথে যেতে পারবে। আমার এই কথাগুলো মোটেও আজগুবি কথাবার্তা নয়। পৃথিবীর অনেক বড় শহরে সাইকেলযাত্রীদের জন্য আলাদা পথের ব্যবস্থা করে রাখা আছে। আজকাল শুধু যে সাইকেলের পথ তৈরি হয়েছে তা নয়, সাইকেল ভাড়া করার জন্য একটু পরে পরে সারি সারি সাইকেল রাখা আছে, কাউকে আর সাইকেল কিনতেও হয় না। তাই আমি মনে করি, নির্বাচনী ইশতেহারে যদি সব বড় বড় শহরে সাইকেলের আলাদা লেন তৈরি করে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়, নতুন প্রজন্ম অনেক আগ্রহ নিয়ে সেটি গ্রহণ করবে।
৯. সোশ্যাল নেটওয়ার্কের অভিশাপ থেকে মুক্তি : আমি এখন যেটি বলতে চাইছি সেটি সবাই মানতে রাজি হবেন কি না আমি জানি না; কিন্তু আমি যেহেতু আমার নিজের পছন্দের কথা বলছি, অন্যরা রাজি না হলেও খুব ক্ষতি নেই।
আমি জানি না সবাই এটি লক্ষ করেছে কি না, ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে একটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, যে পরিবর্তনটি ভালো নয়। ছাত্র-ছাত্রীদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা সাংঘাতিকভাবে কমে এসেছে। এটি শুধু যে আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ঘটেছে তা নয়, সারা পৃথিবীর সব দেশের ছাত্র-ছাত্রীর বেলায় এটি ঘটেছে। এর কারণটিও এখন আর কারো অজানা নয়, সেটি হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নামক বিষয়টির প্রতি আসক্তি। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে সারা পৃথিবী এখন দুটি জগতে ভাগ হয়ে গেছে, একটি হচ্ছে রক্ত-মাংসের বাস্তব জগৎ। আরেকটি ইন্টারনেটের পরাবাস্তব জগৎ। ইন্টারনেটের জগতে একেবারে তুলকালাম ঘটে যাচ্ছে; কিন্তু বাস্তব জগতের কেউ যে সম্পর্কে কিছু জানে না, সেটি এখন এমন কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত না থেকে আক্ষরিক অর্থে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না, সে রকম মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়। সাধারণ মানুষজন হয়তো খুব বেশি জানে না; কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তিজগতের বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠান এখন আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে, যেগুলো হয়তো আমরা নিজেরাই জানি না। তথ্য এখন সোনা থেকেও দামি এবং আমরা না জেনে আমাদের সব তথ্যভাণ্ডার বড় বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিচ্ছি। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে যেটি ফ্রি সার্ভিস মনে হচ্ছে, সেটি যে ফ্রি নয় এবং একবার আমাদের ভালো করে হাতে পেয়ে নিলে হঠাৎ করে গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন বা অ্যাপলের মতো বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠান যে আমাদের সর্বস্ব সুদে-আসলে তুলে নেবে না, আমরা সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারি না।
সারা পৃথিবীতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা কোথায় আছি এবং কোথায় যাব সেটি কেউ ভালো করে জানে না। কিন্তু বোঝার আগে আমরা হয়তো আবিষ্কার করব আমরা অন্যের হাতের পুতুল হয়ে বসে আছি।
তাই আমি চাই নির্বাচনী ইশতেহারে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকুক। পরিবর্তনশীল এই নাজুক পৃথিবীতে বড় বড় তথ্য-প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান আমাদের পুরোপুরি কবজা করে ফেলার আগে আমাদের যেন নিজেদের রক্ষা করার একটি পথ খোলা থাকে। সেই সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আসক্ত ছেলে-মেয়েদের রক্ত-মাংসের জগতে ফিরিয়ে আনার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে।
১০. বাকস্বাধীনতা : আমি জানি বাকস্বাধীনতা কথাটি খুব বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ অনেকবার দেখেছি ঠিক কোথায় বাকস্বাধীনতা খিস্তিখেউড় গালাগাল হয়ে যাচ্ছে, সেটি অনেকেই জানে না। সামনাসামনি অনেকেই একে অন্যকে গালমন্দ করে না; কিন্তু ইন্টারনেটের পরাবাস্তব জগতে খুব সহজেই একজন অন্যজনকে তুলাধোনা করে ফেলে। এ সব কিছুর পরও আমি মনে করি একজনের বাকস্বাধীনতা থাকুক, বাড়াবাড়ি করে ফেললে সেটিকে প্রতিবাদ করার ব্যবস্থা থাকুক। কিন্তু মন খুলে কথা বলা নিয়ে সবার ভেতরে যদি একটি আতঙ্ক কাজ করে, তাহলে সেটি ভালো কথা নয়।
আমার মনে হয় আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তির ৫৭ ধারাটি সবার মাঝে এক ধরনের ভীতি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেটে খিস্তিখেউড় হয়তো কমেছে; কিন্তু অনেক জায়গায়ই মানুষজন তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া জানাতে ভয় পেতে শুরু করেছে। এটি আমরা কখনো চাই না। ৫৭ ধারার বাক্যগুলো খুবই ঢিলেঢালা। ইচ্ছা করলেই যেকোনো মানুষের যেকোনো কথাকে ব্যবহার করে তাকে বিপদে ফেলে দেওয়া যাবে।
তাই আমি মনে করি, নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা বাকস্বাধীনতা নিয়ে আরেকটু গুছিয়ে তৈরি করা একটি প্রস্তাব আশা করতে পারি।
এই হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহারে আমি কী দেখতে চাই, সে রকম ১০টি বিষয়ের তালিকা। দেখাই যাচ্ছে এটি কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ নয় এবং আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাই, ঘুরেফিরে সেগুলোই এসেছে; কিন্তু ক্ষতি কী? এটিই তো বাকস্বাধীনতা—আমার যেটি বলতে ইচ্ছা করছে সেটি বলছি। সবাইকে সেটি শুনতে হবে কিংবা বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে?
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপূর্ব ছুটিতে থাকা অধ্যাপক