নীতিমালার ‘শাক’ দিয়ে সান্ধ্যকোর্সের ‘মাছ’ ঢাকার চেষ্টা ঢাবির | বিশ্ববিদ্যালয় নিউজ

নীতিমালার ‘শাক’ দিয়ে সান্ধ্যকোর্সের ‘মাছ’ ঢাকার চেষ্টা ঢাবির

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সান্ধ্য, উইকেন্ড ও এক্সিকিউটিভ ইত্যাদি কোর্স সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এসব কোর্স বন্ধ হওয়া জরুরি বলে সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী ইউজিসির পূর্ব অনুম

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সান্ধ্য, উইকেন্ড ও এক্সিকিউটিভ ইত্যাদি কোর্স সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এসব কোর্স বন্ধ হওয়া জরুরি বলে সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী ইউজিসির পূর্ব অনুমোদনক্রমে ডিপ্লোমা, শর্ট কোর্স, ভোকেশনাল ও ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করার পক্ষে মত দিয়েছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি। কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন মতামত তুলে ধরা হয়েছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু এর ৪ দিন পর ৩ জানুয়ারি ঢাবি কর্তৃপক্ষ সান্ধ্যকালীন কোর্স চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, সুপারিশের দ্বিতীয় অংশে অনুসারে একটি নীতিমালা প্রনয়ণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যে উদ্যোগকে ইউজিসির ‘মনরক্ষার চেষ্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন,  ঢাবির এ উদ্যোগ শাক দিয়ে সান্ধ্যকোর্সের মাছ ঢাকার অপচেষ্টা।

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ইউজিসির করা সুপারিশগুলোর মধ্যে সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে বলা হয়েছে, দেশের কোনো কোনো পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সান্ধ্যকালীন, উইকেন্ড, এক্সিকিউটিভ কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ধরণের কোর্স পরিচালনা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে বিধায় সান্ধ্যকালীন, উইকেন্ড, এক্সিকিউটিভ জাতীয় সব কোর্স বন্ধ হওয়া উচিত। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী ইউজিসির পূর্ব অনুমোদনক্রমে ডিপ্লোমা, শর্টকোর্স, ভোকেশনাল ও ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করা যেতে পারে। 

কিন্তু এ সুপারিশ প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই দ্রুত সভা করে সান্ধ্যকোর্স চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চপর্যায়ের কমিটির এক সভায় সান্ধ্যকোর্স চালু রাখার বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সান্ধ্য কোর্স চালু রাখা হবে কিনা, রাখা হলে সেটি কোন পদ্ধতিতে চলবে-এ বিষয়ে সুপারিশমূলক প্রতিবেদন ও যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নে বছর দুয়েক আগে উচ্চপর্যায়ের এ কমিটি গঠন করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু রাখা হলেও এর পরিচালনা পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে চায় কমিটি। এ লক্ষ্যে পরিচালনা পদ্ধতিবিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে শিগগিরই তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়া হবে। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিক্ষা অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, সান্ধ্য কোর্স রাখার বিষয়ে কমিটি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা ঢাবির এ উদ্যোগকে ইউজিসির ‘মনরক্ষার চেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঢাবির কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যে সান্ধ্যকোর্সগুলো পরিচালনা করে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী যারা মেধার প্রতিযোগিতা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আপত্তি দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি ইউজিসি সান্ধ্যকোর্সগুলো বন্ধের কথা বলেছে। কিন্তু ঢাবি তা বন্ধ না করে পুরনো কমিটি সামনে এনে নীতিমালা করতে বলেছে। দুই বছর আগের সান্ধ্যকোর্স নিয়ে আলোচনা শুধু শোনা যায়। 

ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট, সান্ধ্যকোর্স শুধুই ব্যবসা। সাধারণ কোনো শিক্ষার্থী অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ঢাবির রেগুলার মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারে না। সে সুযোগ রাখা হয়নি যাতে সান্ধ্যকোর্সের ব্যবসাটা ঠিকভাবে চলে। এখন তারা পুরনো কমিটি এনে নতুন করে নীতিমালার কথা বলছেন। 

তিনি আরও বলেন, স্বায়ত্বশাসনের সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করে ঢাবি প্রশাসন। তারা কারো কথাই বিবেচনা করেনা। নিজেদের যেটা ঠিক মনে হয় সেটাই তারা করছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ শিক্ষার্থীরা, তাদের ভালো মন্দ ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা তারা বিবেচনা করে না।

যদিও ঢাবি প্রশাসন বলছেন,  নীতিমালা হলে সান্ধ্যকোর্সগুলো নিয়মের মধ্যে চলে আসবে। এ বিষয়ে  নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, নীতিমালা হলে এসব কোর্স কোনোভাবেই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালনা করা যাবে না। এ কোর্স রাখার উদ্দেশ্য হবে স্কিলড প্রফেশনাল তৈরি করা। তাই এর প্রচলিত পদ্ধতিতে বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে।

কী ধরনের পরিবর্তন আনা হবে?—এমন প্রশ্নের জবাবে উপ-উপাচার্য আরও বলেন, আগের মতো যেকোনো বিভাগ তাদের ইচ্ছামতো শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে না। প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে শিক্ষার্থী আসন নির্ধারণ করা হবে। শিক্ষকদের মধ্যে কারা কতগুলো কোর্স নেবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। এছাড়া আয়-ব্যয়ের বিষয়ে কিছু নির্দেশনা থাকবে।

২০০২ খ্রিষ্টাব্দে সান্ধ্য কোর্স চালু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ। শিক্ষকদের অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ থাকায় খুব দ্রুতই অন্য বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ ধরনের সান্ধ্য কোর্স। দুই দশকের কম সময়ে ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ৬৯টি সান্ধ্য কোর্স চালু করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান কিছু শিক্ষার্থী এর কঠোর বিরোধীতা শুরু করে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সান্ধ্য কোর্সের যৌক্তিকতা যাচাইয়ে ডিন পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গত বছর সান্ধ্য কোর্স পরিচালন পদ্ধতির বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরে পরিচালনা নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশপূর্বক একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। পাশাপাশি নীতিমালা প্রণয়নের আগ পর্যন্ত সান্ধ্যকোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এ সুপারিশ একাডেমিক কাউন্সিলে উত্থাপিত হলে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক করেন শিক্ষকরা। এরপর সান্ধ্য কোর্সবিষয়ক যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই কমিটিতে দুজন উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সব অনুষদের ডিন ও দুজন ইনস্টিটিউট পরিচালককে সদস্য করা হয়।