পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার চাই - দৈনিকশিক্ষা

পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার চাই

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

গত সপ্তাহে দৈনিক শিক্ষায় পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি লেখা দিয়েছিলাম। সেটি চলমান এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা সামনে নিয়ে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা বোর্ডের বাংলা বিষয়ে গাইড থেকে হুবহু প্রশ্নে এসএসসি পরীক্ষা নেবার সংবাদ পড়ে আজ আবার এ বিষয়ে দু’ চারটে কথা লিখতে বসেছি।   এ খবরটিও দৈনিক শিক্ষাই প্রথম প্রকাশ করেছে। 

গাইড থেকে কিংবা বোর্ডের বিগত বছরগুলোর প্রশ্ন থেকে অবিকল প্রশ্ন উঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নেয়াতে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির মূল থিমটি নষ্ট হতে চলেছে বলে মনে হয়। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির ধারণাটি সমূলে উঠিয়ে দেবার জন্য জ্ঞাতসারে কেউ এ কাজটি করেছে কি না, সে প্রশ্নটি বার বার মনে উকিঁ দিয়ে যায়। নোট গাইডকে শিক্ষায় অপরিহার্য করার জন্য কেউ উঠে পড়ে লেগে রয়েছে বলে মনে হয়।

যথাযথ নিয়ম মেনে সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করলে তা যেমন গাইডের সাথে মেলার কথা নয়, তেমনি বোর্ডের বিগত কুড়ি বছর কেন একশত বছরের প্রশ্নের সাথেও মেলার প্রশ্ন উঠে না। উদ্দীপক যেমন মেলার কথা নয়, তেমন (গ) ও (ঘ) নং প্রশ্ন অর্থাৎ প্রয়োগ স্তর ও উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা স্তরের প্রশ্নগুলো অবিকল হবার অবকাশ নেই। কেবল (ক) ও (খ) নং অর্থাৎ জ্ঞানমূলক ও অনুধাবন স্তরের প্রশ্ন দুটোর যে কোনোটি মিলে যেতে পারে। গাইড থেকে হুবহু প্রশ্ন পরীক্ষায় তুলে দেবার ক্ষেত্রে নোট গাইড বাণিজ্যের সাথে যারা জড়িত, তাদের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে হয়। ভাবতে অবাক লাগে, তাদের হাত এত প্রসারিত যে, তা এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কিংবা অন্যদের সাথেও তাদের নিশ্চয় সখ্যতা আছে। এদের সাথে সখ্যতা না থাকলে কোথাও না কোথাও বিষয়টি আটকে যাবার কথা ছিল।

ঢাকা বোর্ডের চলতি এসএসসি পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের প্রশ্নপত্রে যেটি ধরা পড়েছে তা কেবল দুঃখজনক নয়, গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজও বটে। শুনেছি তদন্ত কমিটি হয়েছে। এটি একটি ট্র্যাডিশন যে, আমাদের দেশে কোথাও কিছু হলেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অমুক মিয়া, তমুক মিয়া কমিটিতে থাকেন। ফল কিছু মেলে না। তদন্ত কমিটি একদিন কোনো তিমিরে লুকিয়ে যায়, কেউ জানতেই পারে না। তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। ঘুরে ফিরে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই আমাদের অবস্থা। এক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি দিয়ে কী হবে?  

প্রশ্ন প্রণেতা, মডারেটর প্যানেল, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক-এদের কাজ কী? মনে হয়, এরা ঘোড়ার ঘাস কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ করে না। কারো দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রথম দায় তার, যিনি প্রশ্ন প্রণয়ন করেছেন। এরপর মডারেটররা কী বলে দায় এড়িয়ে যাবেন? একজন নয়, দু’ জন নয়- চার চারজন মিলে একটি মডারেটর প্যানেল নিয়োগ দেয়া হয়। তারা কী চোখ বুজে কাজ করেছেন? নাকি বোর্ড এমন লোকদের প্রশ্ন প্রণয়ন ও মডারেশনের কাজ করতে দিয়েছে, যারা আদৌ শিক্ষকই নন? এমন প্রশ্ন জাগ্রত হওয়া একান্ত স্বাভাবিক। টাকা খেয়ে এক বিষয়ের শিক্ষককে আরেক বিষয়ের পরীক্ষক কিংবা প্রধান পরীক্ষক নিয়োগ দেয়া গেলে, এরা কী-না করতে পারে?

আমাদের শিক্ষা বোর্ডগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হতে বসেছে। আজ বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে শুরু করে সেকশন অফিসার ও কেরানিদের দুর্নীতি জনসমক্ষে আসতে শুরু করেছে। বিভিন্ন বোর্ডে দলাদলি ও কোন্দল। পরীক্ষার দিকে মনোযোগ দেবার সময় তাদের কোথায়? অতি সম্প্রতি, সিলেট শিক্ষা বোর্ডে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কোন্দল ও দলাদলি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এক পক্ষ আরেক পক্ষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছে। বোর্ড কিংবা অন্য যে কোনো জায়গার কথা বলি না কেন, একমাত্র টাকা পয়সা ভাগাভাগি নিয়ে গ্রুপিং ও দলাদলি হয়ে থাকে। টাকা খেয়ে বোর্ডের কেরানিগুলো অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞদের প্রশ্ন প্রণেতা, মডারেটর, পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক ইত্যাদি নিয়োগ দিয়ে থাকে। এসব এখন ওপেন সিক্রেট। আমাদের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও কোনো বোর্ডের কর্তা ব্যক্তিগুলোর অনৈতিক আর্থিক কর্মকাণ্ড দেখে সত্যি লজ্জায় মরে যাবার অবস্থা।

কেবল ঢাকা বোর্ডের বাংলা বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের মিল নয়, বিভিন্ন বোর্ডের প্রথম দু’ দিনের পরীক্ষায় নতুন ও পুরনো সিলেবাসের ঝামেলা কম হয়নি। আগামী পরীক্ষাগুলোতেও ঝামেলা হবার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোনো কোনো কেন্দ্রে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষার্থীরা ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের আবার ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়েছে। কী তাজ্জব ঘটনা! পুরনো সিলেবাসের শিক্ষার্থীদের আলাদা একটি কক্ষে বসিয়ে দিলে তো এমন হবার কথা নয়।

আসলে দায় দায়িত্ব নিয়ে আমাদের তেমন চিন্তা নেই। দায়িত্বে অবহেলার দায় নিয়ে এ দেশে কেউ কোনোদিন পদত্যাগ করেনি কিংবা কারো জেল ফাঁসিও হয়নি। যদি হতো, তাহলে এর পুনরাবৃত্তি কম হতো। কিংবা একেবারেই হতো না। বৃটিশ আমলে আমাদের এখানে কোনো শিক্ষা বোর্ড ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষা ও পরীক্ষা পরিচালিত হতো। আজ দেশে অনেকগুলো শিক্ষা বোর্ড হয়েছে। কিন্তু তারপরও পরীক্ষা পদ্ধতিতে নানা দুর্নাম দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। শিক্ষার বারোটা বেজে যাচ্ছে। ঠিক সিলেট অঞ্চলের সেই প্রবাদটির মতো- ‘বেশি পুতে বাপ নির্বংশ’। অর্থাৎ, ছেলে সন্তান বেশি হলে পিতার বংশ টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে। আমাদের শিক্ষা ও পরীক্ষার বেলায় সেটি যেন ঘটতে চলেছে।

কোনোভাবেই শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো দায় এড়াতে পারে না। এ সুযোগটি তাদের নেই। যারা বোর্ডের উচ্চ পদস্থ লোক, তাদের প্রায় সকলেই সরকারি শিক্ষক। প্রশ্ন প্রণয়ন ও মডারেশনের উপর তারাও তো একটু চোখ রাখতে পারতেন। নাকি এসবে তাদের কোনো জ্ঞান নেই? তাহলে এরা বোর্ড কী করে চালায়। বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল তাই খেদ করে বলেছেন যে, এরা একটি বাংলার প্রশ্ন করতে না পারলে বোর্ড চালায় কী করে? এটি কেবল ড. জাফর ইকবালের নয়, সচেতন দেশবাসীর প্রশ্ন।

আসলে মেধা মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করা এখন একান্ত দরকার। তা না হলে আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে থাকবে। পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য বিঘ্নিত হতে হতে এক সময় এর কোনো মূল্য থাকবে না। আমাদের শিক্ষা ও পরীক্ষা উভয়টিই আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেমন একটা স্বীকৃত নয়। বিএ, এমএ পাস করা লোকেরা বিদেশে গিয়ে কুলি মজুরের কাজ করে। বিদেশে সস্তায় বিক্রি হয় দেশের মানব সম্পদ। অনার্স-মাস্টার্স পাস করা ছেলেমেয়েদের বিদেশ যেতে আইইএলটিএস করা লাগে। আমাদের শিক্ষা ও পরীক্ষাকে বিদেশিরা দাম দেয় না বলে আলাদা করে লেখাপড়া শিখে যাওয়া লাগে। এ সব খুব লজ্জা শরমের কথা।

আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির আশু সংস্কার প্রয়োজন। মূল্যায়নের বিকল্প কোনো পথ বের করা যায় কি না, সে নিয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলকে ভেবে দেখতে হবে। আমাদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও মানসিকতা বদলাতে হবে। পরীক্ষার জন্য শিক্ষা নয়, শিক্ষার জন্য পরীক্ষা-এ ধারণাটি ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের মনে জাগিয়ে দিতে হবে। রেজাল্ট কিংবা চাকরি নয়, মানুষের মতো মানুষ হবার জন্য শিক্ষা অপরিহার্য-সেটি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। উপলব্ধিতে আনতে হবে।

পরীক্ষায় ফেলের কোনো দরকার নেই। প্রয়োজনে আরেকটি গ্রেড বাড়িয়ে সকলকে পাস দিয়ে দেয়া দরকার। ফেলের কী দরকার? যারা সি, ডি গ্রেডে পাস করে, তারাও তো এক রকমের ফেল। জীবনে তাদের এই ফল কোনো কাজে আসবে না। তাই যারা ফেল করে, তাদের একটা ছোটখাট গ্রেড দিয়ে পাস দিয়ে দিলে কী হয়? অনেকটা এদের কারণে প্রশ্নফাঁস হয়। নোট গাইড চলে। কোচিং ব্যবসা জিইয়ে থাকে। ফেলের ভয়ে পরীক্ষায় আকাম-কুকাম সব কাজ চলে। তাই ফেলের ধারণাটি উঠিয়ে দেয়া দরকার।

লিখিত পরীক্ষার চেয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষাটি যদি যথাযথভাবে নেয়া যেত, তবে ফল পাওয়া যেত। মৌখিক পরীক্ষা নেয়া গেলে আরও ভালো হতো। ব্যবহারিক পরীক্ষার নামে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে কেবল নম্বর দেবার আয়োজন ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। ধারাবাহিক মূল্যায়নে কোনো সুফল আসছে বলে মনে হয় না। ইংরেজি বিষয়ে লিসেনিং ও স্পিকিং এবং অন্যান্য বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও ব্যবহারিক পরীক্ষা যদি কেবল কাগজে কলমে নয়, বাস্তবে কার্যকর করা যেত তবে সুফল পাওয়া যেত। মুখস্ত করে লেখাপড়ার যমানা এখন আর নেই। এখন জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার দরকার। হাতে কলমে শিক্ষার প্রয়োজন।

আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষা চালু করে মুখস্ত বিদ্যাকে নির্বাসন পাঠানোর এখন উপযুক্ত সময়। সনাতন পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার সাধন করার জন্য পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুনো দরকার। তা না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রত্যাশা করা দুরাশার নামান্তর হবে। গোটা পরীক্ষা পদ্ধতি দিনে দিনে নানা বিতর্কে আরও জড়িয়ে পড়বে।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।  

সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.016908884048462