মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন সরকারি কলেজের জন্য দশটি বিষয়ে মোট ৫১৪ জন প্রদর্শক নিয়োগে চলছে টাকার খেলা। গত ২৭ আগস্ট প্রায় ৬০ হাজার প্রার্থী ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা দিয়েছেন। নিয়োগ কমিটির কেউ কেউ লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে থাকলেও তা হয়নি। টাকার বিনিময়ে সরকারি কলেজগুলোতে নিয়োগ পেতে যাওয়া এই প্রদর্শকরাই পরবর্তীতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত হবেন। পদোন্নতি পেয়ে তারা অধ্যাপকও হতে পারবেন। যেহেতু শিক্ষা ক্যাডারে পার্শ্বপ্রবেশের সুযোগ রয়েছে। তাই শিক্ষা ক্যাডারের সৎ কর্মকর্তারা এই এমসিকিউ পরীক্ষা বাতিল করে আইবিএর অধীনে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, প্রদর্শকরা যাতে শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত না হতে পারে পারেন সেজন্য কয়েক বছর পর এই নিয়োগবোর্ডের সভাপতিই তার জুনিয়রদের উসকে দেবেন ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দাবি তোলার। এই প্রদর্শকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাবেন।
জানা যায়, ৫১৪ জন প্রদর্শক নিয়োগে পাঁচ সদস্যের কমিটির সভাপতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী। অধিদপ্তরের সাধারণ প্রশাসন শাখার উপ-পরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস সদস্য-সচিব এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে কর্মকর্তা এর সদস্য।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৭ আগস্ট বিকেলে পরীক্ষা শুরু হওয়ার দুই দিন আগে থেকেই রাজধানীর বকশিবাজারে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডর অফিসার্স কোয়ার্টার্সের একটি কক্ষে দফায় দফায় গোপন বৈঠক চলে। এই কক্ষের ঠিক বিপরীত দিকের ভবনটাতেই ফল তৈরি হচ্ছে। অন্যান্যদের সঙ্গে সেসব বৈঠকে যোগ দেন হামিদ ও দুলাল নামে দুই ব্যক্তি। তারা নিজেদেরকে ঢাকা বোর্ডের কর্মকর্তা পরিচয় দিলেও দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই নামে কোনো কর্মকর্তা বোর্ডে নেই। যদিও তাদের ব্যবহৃত রেজিস্ট্রেশন করা মোবাইল নম্বরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরিচয়ই রয়েছে। তাদেরকে দিনের বেলায়ও ঢাকা বোর্ডেই দেখা যায়। তাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী প্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ঘুষ বাবদ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দফায় দফায় বৈঠক চলা ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের সেই কক্ষটিতে অবৈধভাবে বসবাস করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক। সেই পরিচালকই এই ৫১৪ জন প্রদর্শক নিয়োগ কমিটির সভাপতি। এই সভাপতির বিরুদ্ধে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার দগদগে ইতিহাস রয়েছে। নজিরবিহীনভাবে তিনি নিজেই ওই নিয়োগবোর্ডে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষায় মাত্র তিন পাওয়া প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। [নিয়োগবোর্ড মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার দায়িত্বই ছিলো তার। ঢাকার কোনো সরকারি কলেজের কোনো অধ্যাপককে দায়িত্ব না দিয়ে নিজেই নিজের প্রতিনিধি বনে যান।] অধ্যক্ষ পদের সেই প্রার্থী রুমানা শাহীন শেফা ছিলেন দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত ও জেলখাটা দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের স্ত্রী। নিয়োগ পরীক্ষার এসব জালিয়াতির খবর দৈনিক শিক্ষাডটকমসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর নিয়োগ বাতিল হয়ে যায়।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শোকের মাস আগস্টের ২৪ তারিখ বৃহস্পতিবার গভীর রাতে রাজধানীর তারকাখচিত হোটেল ওয়েস্টিনের নিচে গুলিবিদ্ধ হন ৫১৪ জন প্রদর্শক নিয়োগ কমিটির এই সভাপতি। তিনি তখন ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের সচিব পদে ছিলেন। বোর্ডে থাকাকালে অবৈধভাবে শত শত স্কুল ও কলেজের অনুমোদন দেয়ার অভিযোগ এখনও দুদকের তদন্তাধীন। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত ওই গোলাগুলির ঘটনার রহস্য আজও অজানা।
এই সভাপতি যখন ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের সচিব ছিলেন তখন মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে ‘জিপিএ ফাইভ বিক্রির অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন সম্প্রচারিত হয়েছিলো।’
নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্বে কেন শিক্ষা ক্যাডারের বিতর্কিতরা? প্রশ্ন কেন এমসিকিউ? ফল কেন ঢাকা বোর্ডে?:
নিয়োগের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে এই অধিদপ্তরে ১৯৬৫ জন জনবল নিয়োগের জন্য পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করার ‘অবৈধ’ দায়িত্ব পেয়েছিলেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সমিতির কয়েকজন বিতর্কিত নেতা। তারা অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির কেউ না হলেও তারাই প্রশ্ন তৈরি করেছিলেন। রাতের বেলা শিক্ষা অধিদপ্তরে সেই প্রশ্নপত্র ফটোকপি করা মাস্টাররোলের পিওনই সকালে সেই প্রশ্নে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এ নিয়োগ নিয়ে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হওয়ার অভিযোগ উঠেছিলো। দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রথমে স্থগিত ও পরে বাতিল হয় সেই পরীক্ষা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এ এস মাহমুদের তদন্তের সুপারিশে দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ প্রকাশিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সেই পরীক্ষা চূড়ান্তভাবে বাতিল হয় এবং পরবর্তীতে নতুন করে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অধীনে। এমন অভিজ্ঞতা থাকার পর কেন আবার বিশাল নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্বে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা? কেন তাদের অধীনে পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং ঢাকা বোর্ডে ফল তৈরি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য গতকাল বুধবার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘এই প্রদশর্করাই পরে শিক্ষা ক্যাডার হবেন। পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক পর্যন্ত হতে পারবেন। তাদের নিয়োগ কঠিন লিখিত পরীক্ষা হওয়ার পক্ষে আমি ছিলাম, কিন্তু পারিনি।’ ‘পরীক্ষা বিষয়ে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এসআরও মানা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষায় কয়েকজন জনবলকে নিয়োগ দেওয়ার পর বাতিল করতে হয়েছিলো। প্রার্থীরা বডি পরিবর্তন করেছিলেন।’
দৈনিক আমাদের বার্তার এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুরোধে আমরা ফল তৈরি করে দিচ্ছি। এতে বোর্ড কিছু টাকা পাবে। আমরা আরো অনেকের ফল তৈরি করে দিই। সবাই আমাদের ওপর ভরসা করেন।’
নিয়োগ পরীক্ষা কমিটির সভাপতি রাতের বেলায় কেন বোর্ডে অবস্থান করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা দেখবেন বোর্ডের সচিব তপন কুমার।’
দশ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকা বোর্ডেরই বিভিন্ন পদে কর্মরত বর্তমান সচিব তপন কুমার সরকার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘বোর্ডের অফিসার্স কোয়ার্টার্সে শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক কেন থাকেন তা আমি জানি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ডের একজন কর্মচারী বলেন, ‘সম্প্রতি পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বোর্ডেরই কারো কারো সহায়তায় ফেল করা শিক্ষার্থীকে পাস দেখানো হয়। দালালচক্রের সঙ্গে এদের রয়েছে সখ্য। অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে আরেকবার সমালোচনা ও মিডিয়ার নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাবোর্ডটি।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক একজন মহাপরিচালক বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অথবা অধিদপ্তরের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরীক্ষার ফল প্রস্তুত না করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডকে ফল তৈরির জন্য ‘নিরাপদ ও উপযুক্ত’ বিবেচনা করানোর মধ্যেই দুর্নীতির বীজ রয়েছে।’
এমসিকিউ পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
জানা যায়, গত বছর অক্টোবর মাসে অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন জেলা-উপজেলার শিক্ষা অফিস এবং সরকারি স্কুল-কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মোট চার হাজার ৩২টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মাউশি অধিদপ্তর। নয় লাখের বেশি আবেদন জমা পড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বর থেকে মাউশি অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট অবৈধ উপায়ে এসব পদে নিয়োগের উদ্দেশ্যে আর্থিক লেনদেন শুরু করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি আঁচ করার পর গত বছর ১৫ ডিসেম্বর মাউশি অধিদপ্তর থেকে সতর্কতা জারি করে বলা হয়, গত ২২ অক্টোবর [২০২০] নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। এখন পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি ও দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রতারক চক্র চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আবেদনকারী প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করার চেষ্টা করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক আমাদের বার্তা, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১।