পাঠ্যপুস্তকে ভুল ছাপানো আর পাঠ্যপুস্তকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ঢোকানো এক কথা নয়। প্রথমটা দায়িত্বহীনতা আর দ্বিতীয়টা এক ধরনের সচেতনতা। ছদ্মকৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রখর সচেতনভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ ঢোকানোর প্রক্রিয়া চলছে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকে। এর বিরুদ্ধে একটা মৃদু আন্দোলন চলছে। দেশের ৮৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন। সে দিন মতিঝিল দৈনিক আমার সংবাদ পত্রিকা অফিস থেকে কাজ সেরে নিচে নেমে দেখি, পাঠ্যপুস্তক নিয়ে একটি ক্ষুদ্র সমাবেশে বেশ কয়েকজন নাগরিক জোরগলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। তারা বলছিলেন, পাঠ্যপুস্তক থেকে মানবিক গুণসম্পন্ন লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষী লেখা কৌশলে ঢোকানো হয়েছে।
দৈনিক সমকালে দেখেছি, ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে অসংখ্য ভুল, দলীয় স্লোগান এবং নানা সাম্প্রদায়িক উপাদান যুক্ত করার প্রতিবাদে মানববন্ধন করছে ছাত্র ফেডারেশন। শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলা ওই মানববন্ধনের আয়োজন করে। মানববন্ধনে বক্তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভুল ও অনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের বিপথে চালিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক উপাদান যুক্ত করে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে খুশি করা ও ভবিষ্যতে একটি সাম্প্রদায়িক জাতি রাষ্ট্র গঠনের সূ² পাঁয়তারার বিরুদ্ধে বক্তারা বক্তৃতা করেন।’(১৫/০১/১৭)।
একই ধরনের অভিযোগ তুলেছেন দেশের ৮৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এদের মধ্যে আছেন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল লোহানী ও সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখরা। দৈনিক সমকাল আরো জানাচ্ছে, ‘পাঠ্যবইয়ে ভুল ও বিকৃত তথ্য ছাপানোর কাজে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীরা। গতকাল শনিবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত দৃটি পৃথক সমাবেশ থেকে এ দাবি জানানো হয়। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশের আয়োজন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন বলেন, পাকিস্তান আমলে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হতো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সরকারের সময় এই ধরনের ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রেসক্লাবের সামনে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের আয়োজিত এক সমাবেশে সংগঠনটির সভাপতি কবীর চৌধুরী বলেন, পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে কৌশলে শিশুদের মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকানো হচ্ছে।’
গত শনিবার সকালে সমকাল গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত ‘প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়ন : নাগরিক সমাজের ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় সমকাল কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ আলোচনা বৈঠক। এতে অংশ নেন, দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও গণসাক্ষরতা অভিযানের কর্মকর্তারা। সভাপতিত্ব করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। এই আলোচনা টেবিলের মোক্ষম বক্তব্য, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বিষয় এক সঙ্গে রাখা চলবে না।’ তারা বলেন, ‘যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেশমাত্র বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে নেই।’
প্রগতিশীল বিদ্বানদের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে হেফাজতের আমির আল্লামা শফীর বিবৃতি দেখলাম একটি দৈনিকে। তাতে বলা হয়েছে, ‘হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ‘নাস্তিক্য বাদ ও হিন্দুতত্ত্বের বিষয়বস্তু’ বাদ দেয়ার সরকারের ‘প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক’ উদ্যোগে ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীর গায়ে জ্বালা ধরেছে বলে মন্ত্রব্য করেছেন সংগনটির সভাপতি শাহ আহমদ শফী। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও প্রতিবাদের ফলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টির গুরুত্ব ও নাজুকতা বুঝতে পেরে সিলেবাসে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন।’
আরো বলেছেন, ‘কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের দাবি শতভাগ পূরণ হয়েছে বলে যারা বিতর্ক তুলে ইসলামী ভাবধারার গল্প-কবিতার প্রতি আঙুল তুলেছেন তারা ইমানি চেতনাবোধ মুছে বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষ ও নাস্তিকতা ছড়িয়ে দেয়ার এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন।’ (যায়যায়দিন-১৫/০১/১৭)। আবার ওদিকে, ‘প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন করেছে আওয়ামী ওলামা লীগসহ ১৩টি ইসলামী দল।
এ বিষয়ে ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপনের কারণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তকে বানান ভুলসহ পাঠ্যসূচি নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক সৃষ্টির কারণে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। সরকারের উন্নয়নের ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং ধর্মহীন হিসেবে তুলে ধরতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সরকারের নির্দেশনা ছাড়াই সুপ্রিম কোর্টে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রধান বিচারপতি মূর্তি স্থাপন করেছেন, যা কোনো বিচারপতি ও আইনজীবী পছন্দ করছেন না। এছাড়া একটি অংশ পরিকল্পিতভাবে পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে দিচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকারকে কোনো ষড়যন্ত্র প্রশ্রয় না দিয়ে প্রধান বিচারপতি এবং শিক্ষামন্ত্রীর অপসারণ করতে হবে।’ (যায়যায়দিন- ১৫/০১/১৭)।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মনীষী মোতাহার হোসেন চৌধুরী তো বলেছেন, মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষিত হওয়া নয়, সংস্কৃতিবান হওয়া। খুব খাঁটি কথা। তাই এখনো লক্ষ করি, মৌলবাদীরা একই সঙ্গে যেমন সেক্যুলার শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তেমন সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করেছে। বিএনপি-জামায়াতের আমলে স্বাধীনতা ভাস্কর্য, লাললের ভাস্কর্য, উড়ন্ত বলাকার ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে এবং এসব শিল্পকর্ম নিয়ে জেহাদ হয়েছে। এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সম্মুখযুুদ্ধে পরাস্ত হয়ে মৌলবাদীরা ভিন্ন কৌশলে ওই একই জেহাদ শুরু করেছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
যে মওলানা শফী বর্তমান সরকারকে নাস্তিক বলেছিলেন, সরকারের পতন ঘোষণা করেছিলেন, সেই সরকারের পক্ষ নেয়ার ন্যক্কারজনক এক প্রতারিত কৌশল অবলম্বন করেছেন। আওয়ামী ওলামা লীগসহ এরা প্রো-জামায়াতি গোষ্ঠী। মওলানা শফী বলার চেষ্টা করেছেন, শেখ হাসিনা তার মতো স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার মওলানার সঙ্গে পরামর্শ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছেন। এখানে শিক্ষামন্ত্রীর সতর্কতার অভাব আছে। তিনি পরিশ্রম সহকারে সার্বিক ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করেননি। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে শিক্ষা প্রশাসনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা জামায়াতি ছদ্মবেশীরা পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক বিষয় ঢুকিয়েছে। মওলানা শফী দাবি করেছেন, ‘এই সরকার ‘হিন্দুত্ব’ ছেঁটে ফেলেছে পাঠ্যপুস্তক থেকে।’ এটা জঘন্য মিথ্যা কথা। সরকারকে ডিস কালার করার হীন পরিকল্পনা। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ঢোকানো এক গভীর ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। আমরা অবশ্যই এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। আমরা ছাত্র ফেডারেশন, উদীচী ও দেশবরেণ্য ৮৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক এবং সমকাল অফিসে গোলটেবিল বৈঠকের সঙ্গে সহমত পোষণ করি।
মওলানা শফীরা কথায় কথায় নাস্তিকতা টেনে আনছেন জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। পাঠ্যপুস্তকে বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকে প্রগতিশীল লেখকরা কখনো ধর্মবিরোধী বক্তব্য দেননি। তারা শিশুদের শেখাতে চান জ্ঞানের কথা, নীতির কথা, যুক্তি ও বিজ্ঞানের কথা। যে কোনো ধর্মের জ্ঞানী, মনীষী, মহাপুরুষদের কথা শিশুদের শেখাতে চান। ক‚পমণ্ড‚কতা, অন্ধবিশ্বাস, ধর্মান্ধতা, উগ্রতা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা কেন শিখবে শিশুরা? জ্ঞানচর্চাকে যারা নাস্তিকতা বলে তারাই পবিত্র কুরআন শরিফ পুড়িয়ে দিতে পারে। মওলানা শফীরা খেয়াল করেন না যে, আজকাল বিজ্ঞানের অবদান ছাড়া মসজিদও চলে না। বিদ্যুৎ ও মাইক তো বিজ্ঞানের দান।
সরকারের কৌশলের মধ্যে আপসনীতি আছে। এটাই বিপদ ডেকে আনছে। এখানে জায়গা কম তাই সংক্ষেপে বলি, ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করলে সরকারের ওপর মৌলবাদী চাপ থাকবেই।