শিক্ষার্থীদের জন্য ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপাতে কাগজ আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের দাবিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। একইসঙ্গে কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছেন প্রকাশকরা। প্রকাশকরা বলছেন, সময়মতো পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ করতে তারা অন্যান্য সব বই ও প্রকাশনা ছাপা বন্ধ রেখেছেন। অন্য বইয়ের জন্য কাগজ কেনাও হচ্ছে না। তারা আশা করছেন শিক্ষার্থীরা সব বই পাবেন। তবে, শিক্ষার্থীদের সব পেতে দুই তিনমাস সময় লাগতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন প্রকাশক নেতারা।
মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমিতির পক্ষ থেকে কাগজ আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, দেশের বাজারে এখন মুদ্রণ এবং লেখার কাগজের যে সংকট চলছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কাগজের যে আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তা স্বাধীন বাংলাদেশে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। এ ভয়াবহতার চিত্র এতই প্রকট যে, আসন্ন শিক্ষাবর্ষে দেশের কোটি কোটি কোমলমতি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন যেমন বিঘ্ন ঘটবে, তেমনি ২০২৩-এর অমর একুশে বইমেলায় এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারের মন্দার ঢেউ বেশি আঘাত হেনেছে আমাদের কাগজের বাজারের ওপর, যা দেশের নানাবিধ প্রকাশনার মূল উপাদান এবং শিক্ষার প্রধান উপকরণ। কাগজ তৈরির কাঁচামাল (পাল্প) অধিক মূল্যে, বর্ধিত ব্যয়ে দেশে এনে কাগজ তৈরিতে উৎপাদন খরচ অনেকাংশেই বেড়ে গেছে। বর্তমানে এ বৃদ্ধি ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ বা তারও বেশি।
কাগজের দামের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে মো. আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে ৮০ গ্রাম ডিডি অফসেট কাগজের দাম ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা রিম, এখন তার দাম ৩ হাজার টাকার বেশি। ১০০ গ্রামের একই কাগজের যেখানে ২০২১ সালে দাম ছিল ১ হাজার ৭৫০ টাকা রিম, এখন তার দাম ৪ হাজার ২০০ টাকা। অন্যদিকে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে ২০x৩০ ইঞ্চি নিউজপ্রিন্ট ডিসি কাগজের রিম প্রতি দাম ছিল ৩৮০ টাকা, এখন তার দাম ১ হাজার টাকা। একই কাগজের ডিডির দাম ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে ছিল ৪৪৫ টাকা রিম, এখন তার দাম ১ হাজার ১৮০ টাকা। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যবসায়িক দুর্নীতি ঘটছে কি না, কোনো দুষ্টচক্র দেশের কাগজ ও প্রকাশনা বাজারের বিরুদ্ধে দুরভিসন্ধিমূলক কাজে লিপ্ত আছে কি না, সে বিষয়ে আমাদের এবং সদাশয় সরকারের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, সরকার আগামী এক মাসের মধ্যে দেশের শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি বই তুলে দেবে। তাতে অপরিহার্যভাবে খরচ হবে যে কাগজ, তার পরিমাণ পাহাড়প্রমাণ। তদুপরি আগামী দুই মাসের মধ্যে হতে যাওয়া অমর একুশে বইমেলায় বই প্রকাশনার জন্য প্রচুর কাগজের ব্যবহার হবে। সহজ শর্তে বিনা শুল্কে অথবা স্বল্পশুল্কে কাগজ আমদানি করা না গেলে বই বিতরণ ও বইমেলায় চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি করবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, গত দুই-আড়াই বছর কোভিড পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায়, প্রতি বছর যে ওয়েস্টেজ কাগজকে রিসাইকেলযোগ্য কাঁচামাল হিসেবে পাওয়া যায়, সেটা পাওয়া যায়নি।
আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, চাহিদার সঙ্গে অন্যান্য একাডেমিক ও সহায়ক বই, শিক্ষার্থীদের খাতাপত্র, শিক্ষাবোর্ডের খাতা ও নথিপত্র, প্যাকেজিং শিল্প, ব্যাগশিল্প, খাম, বিভিন্ন সংবাদপত্র, দাপ্তরিক কাজ, পোস্টার, ডেকোরেশন ইত্যাদি কাজে যে পরিমাণ কাগজের চাহিদা, তা বেড়েই চলেছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে কাগজের আমদানি শুল্ক যদি কমানো না হয়, তাহলে খুব শিগগিরই কাগজের বাজারে ব্যাপক বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি হবে।
পাঠ্যবই ছাপার কাজের অগ্রগতি নিয়ে সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের জবাবে সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, সময়মতো পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ করতে অন্যান্য সব বই ও প্রকাশনা ছাপা বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্য বইয়ের জন্য কাগজ কেনাও হচ্ছে না। এসব বিষয়ে আমরা বাইন্ডার্সদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আশা করছি শিক্ষার্থীরা সব বই পাবেন। তবে, ধাপে ধাপে। শিক্ষার্থীদের সব পেতে দুই তিনমাস সময় লাগতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে কিছু দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো, উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সরকারি প্রতিনিধি, কাগজের মিল মালিক, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির প্রতিনিধি এবং কাগজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও কারণ চিহ্নিত করে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দ্রুত বিদেশ থেকে কাগজ আমদানিতে শুল্কমুক্ত ঘোষণা করা। দেশের সব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কাগজকে রিসাইকেলিং কাজে ব্যবহার করার ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক রাখা। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর গুদামজাতকৃত কাগজ (যদি থাকে), তাহলে তা স্বাভাবিক মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা। শুল্ক হ্রাস বা মুক্ত করা ছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি বা প্রণোদনামূলক ছাড় দেয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা।