এনটিআরসিএর সুপারিশ পেয়ে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে যোগদান করতে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়ছেন প্রার্থীরা। প্রার্থীদের অভিযোগ, তাদের কাছে লাখ লাখ টাকা দাবি করা হচ্ছে। পীরের প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষককে যোগদান করতে না দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। আবার সরাসরি টাকা না চেয়ে দাবি করা হচ্ছে কম্পিউটার বা বিভিন্ন আসবাবপত্র। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধানদের যোগসাজশে প্রার্থীদের জিম্মি করছেন। কিন্তু অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা গণমাধ্যমকে বলতেও ভয় পাচ্ছেন অনেকে। তাদের শঙ্কা, এসব নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলে তাদের এমপিওভুক্তিতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জটিলতা সৃষ্টি করবে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রার্থীদের দেয়া হচ্ছে চাপও। তাই ভয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না ভোগান্তিতে থাকা প্রার্থীরা। যদিও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী এনটিআরসিএর সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের যোগদানে বাধা দিলে সভাপতি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি ৩৪ হাজারের বেশি নিবন্ধিত প্রার্থীকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। কিন্তু সুপারিশের পর যোগদান করতে গিয়ে সমস্যায় পড়া প্রার্থীরা এসব নিয়ে খোলাখুলি কথা না বললেও বেশিরভাগ প্রার্থী প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকে দাবি করার টাকার কিছু কম দিয়ে প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে চাচ্ছেন। কোনো কোনো প্রার্থী আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তারা ঘুষের টাকা জোগাড়ে হন্যে হয়ে ঘুরছেন।
এমপিওভুক্তিতে জটিলতার ভয়ে টাকা দাবি করা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের পরিচয় বা তথ্য দিতে না চাইলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীরা শিক্ষক পদে যোগদান করতে অনৈতিকভাবে টাকা দিতে চাচ্ছেন না। তারা এ বিষয়ে এনটিআরসিএ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ ও ঘুষের অভিযোগ পুরনো। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়ার বিস্তর অভিযোগ ছিল। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের গ্লানি থেকে বেরিয়ে আসতে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থী সুপারিশের দায়িত্ব এনটিআরসিএকে দেয় সরকার। তিনধাপে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগের জন্য এনটিআরসিএর সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের কাছ থেকেও টাকা দাবি করা হচ্ছে। এতে এনটিআরসিএকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
রাজনৈতিক চাপ ও এমপিও জটিলতার ভয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না প্রার্থীরা:
অনেক প্রার্থী অভিযোগ করে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলছেন, তাদের কাছ থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাকা দাবি করছেন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। ক্ষেত্র বিশেষে চাওয়া হচ্ছে কম্পিউটার। অনেকে চাচ্ছেন আসবাবপত্র।
ফিরোজ নামের একজন প্রার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, তিনি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার একটি মাধ্যমিক স্কুলে সুপারিশ পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি তার কাছে চার লাখ টাকা দাবি করছেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন তিনি। জানতে চাইলে ফিরোজ বলেন, ‘বাঘের খাঁচায় বাস করে কি বাঘের সঙ্গে লড়াই করা যায়’। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি একজন সাংসদের ভাই। তাই তার নাম বলতে ভয় পাচ্ছেন ফিরোজ।
ফিরোজ আরও জানান, ‘আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। প্রতিষ্ঠান প্রধান আমাদের সামনেই সভাপতিকে বলেছেন এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেয়া উচিত হবে না। কিন্তু সভাপতি বলেছেন উনাকে খুশি না করে কিভাবে নিয়োগ হয় তা উনি দেখে নেবেন। আমরা খুবই অসহায়।’
পীরের মাদরাসায় মহিলা শিক্ষক নিয়োগ হবে না :
বাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার একটি আলিম মাদারাসায় একজন প্রার্থী শুধু মহিলা হওয়ায় তাকে যোগদান করতে দিতে চাচ্ছে না প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। ওই প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থী ফারজানা খন্দকার দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, ওই প্রতিষ্ঠানের অধীনে মাজার আছে। ওই মাজারের পীর সাহেব নিজেই সভাপতি। মঙ্গলবার যোগদান করতে প্রতিষ্ঠানে গেলে অধ্যক্ষ খুবই ভালো ব্যবহার করেছেন। তবে, সভাপতির সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সাফ বলেছেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে কোনো মহিলা চাকরি করবে না।’ তিনি আরও বলেন, তবে প্রতিষ্ঠান প্রধান বলেছেন তিনি সভাপতিকে রাজি করাবেন। এজন্য তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য প্রার্থীদের মতো ভয়ে মাদরাসারটির নাম বলতে চাচ্ছেন না তিনি।
মতিয়র রহমান নামের অপর এক প্রার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, তিনি একটি মাদরাসায় নিয়োগ পেয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে গেলে তার কাছে কম্পিউটার দাবি করা হয়। মতিয়র বলেন, প্রথমে মাদরাসা প্রধান ভালো ব্যবহার করেছেন। পরে যোগদান নিয়ে আলোচনার পর আমাকে বলেছেন প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেছে, এ বিষয়ে কিছু করতে।
মতিয়র আরও বলেন, আমি তাকে জানিয়েছি ২০ হাজার টাকা দেবো। তিনি বলেছেন সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে জানাবেন।
কিন্তু মাদরাসাটির নাম-অবস্থান, সভাপতি ও প্রধান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে নারাজ মতিয়র। এ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান যদি ২০ হাজার টাকায় রাজি না হলে সাংবাদিকদের সব তথ্য দেবেন তিনি। সভাপতি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় বেশি ভয় পাচ্ছেন বলে জানান এ প্রার্থী।
মাসুদ নামের সুপারিশপ্রাপ্ত এক প্রার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি সুপারিশ পেয়েছেন। কিন্তু মাদরাসা প্রধান তার কাছে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেছেন। তিনি বলছেন, এমপিওভুক্তির জন্য এ টাকা চাওয়া হয়েছে। মাসুদ বুঝতে পারছেন না তিনি কি করবেন।
সুপারিশপ্রাপ্তদের যোগদানে বাধা দিলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা :
জানা গেছে, এনটিআরসিএর সুপারিশ পাওয়া শিক্ষকদের যোগদানে বাধা দিলে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জারি হওয়া এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএতে শিক্ষক-প্রদর্শকের চাহিদা দিলে ওই পদে এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশ করা শিক্ষক ও প্রদর্শককে নিয়োগ দিতে হবে। চাহিদা দেয়ার সময় পদটি এমপিও বা নন-এমপিও তা সুস্পষ্ট করে লিখতে হবে। প্যাটার্ন অতিরিক্ত চাহিদা দিলে শিক্ষক বা প্রদর্শকের শতভাগ বেতন-ভাতা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাহ করতে হবে। এ শর্তের ব্যত্যয় ঘটলে প্রতিষ্ঠান প্রধানের বেতন-ভাতা স্থগিত বা বাতিল করা হবে এবং কমিটির সভাপতির পদ শূন্য ঘোষণাসহ তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু এ হুঁশিয়ারির পরেও প্রতিষ্ঠান থেকে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের যোগদানে বাধা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনটিআরসিএর হস্তক্ষেপ দাবি :
এদিকে এ জটিলতা এড়াতে ও প্রার্থীদের ঘুষমুক্ত যোগদান নিশ্চিত করতে এনটিআরসিএর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন প্রার্থীরা। জানা গেছে, দ্বিতীয় নিয়োগ চক্রেও অনেক প্রার্থীকে যোগদান করতে দেয়া হচ্ছিল না। পরে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল। ভুক্তভোগী প্রার্থীরা এবারও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনটিআরসিএকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী শান্ত আলী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, প্রার্থীরা যেন প্রভাবমুক্তভাবে প্রার্থীদের যোগদানের ব্যবস্থা করতে এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যেন কোনো টাকা আদায় না করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর যোগদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার সাথে দ্রুত শেষ করা দাবি জানাচ্ছি। আমরা স্বচ্ছভাবে নিয়োগ পেয়েছি। ঘুষ দিয়ে যাতে কোন শিক্ষকের মহান পেশাজীবন শুরু করতে না হয়।
শিক্ষা প্রশাসন যা বলছে :
এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের যোগাদন করতে না দিলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এমপিও নীতিমালা বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যদি কাউকে যোগদান করতে না দেয় তাহলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা। এনটিআরসিএ যদি মন্ত্রণালয়কে এসব তথ্য পাঠায় তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে এনটিআরসিএর সচিব মো. ওবাইদুর রহমান দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, আমরা সুপারিশপত্রে উল্লেখ করে দিয়েছি যোগদানে বাধা দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে, বাস্তবতা হচ্ছে প্রার্থীদের কাছে বিভিন্ন নামে টাকা চাচ্ছেন। এর আগেও যোগদানে বাধা দেয়া প্রতিষ্ঠান প্রধানদের তথ্য আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠালে মন্ত্রণালয় জড়িতদের এমপিও বন্ধ করেছে ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রার্থীরা যদি সুস্পষ্টভাবে তথ্য দিয়ে এনটিআরসিএকে অভিযোগ জানান তাহলে আমরা সব যাচাই বাছাই করে মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবো। প্রার্থীদের যোগদানে বাধা পাওয়া প্রার্থীদের এনটিআরসিএতে সুস্পষ্ট তথ্যসহ অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এ কর্মকর্তা।