ছোটবেলায় পরীক্ষার খাতায় ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় বেশিরভাগ শিশুই ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করতো। আমি নিজেও তা লিখতাম। তবে এসএসসিতে বায়োলজিতে নাকানিচুবানি খাবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এইচএসসিতে বিষয়টি বাদ দিয়ে দেবো। সেটাই করলাম। বায়োলজি বাদ দিয়ে কম্পিউটার নিলাম। আমার ডাক্তার হবার সম্ভাবনাও সেখানেই নিহত। আমার মা-বাবাও অত্যন্ত রুষ্ট হলেন।
ডাক্তার হতে হবে, এমন চাপ প্রায় সব মধ্য নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারেই থাকে। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা খারাপ কিছু না। আমাদের সতের কোটির দেশে প্রচুর ডাক্তার অবশ্যই দরকার। কিন্তু গোল বেঁধেছে এবারের ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাস নিয়ে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসির বোর্ড পরীক্ষা যেহেতু সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাই মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষাও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসেই হবে, এটাই সবাই ভেবেছিলো। প্রিপারেশনও সেভাবেই নিয়েছিলো। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও ভর্তি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছিলেন। ঢাবিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতেও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসেই ভর্তি পরীক্ষা হবে। ফলে শিক্ষার্থীরাও সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলো। এখন পরীক্ষার অল্প কিছুদিন আগে বলা হচ্ছে মেডিক্যাল অ্যাডমিশন টেস্ট পুরো সিলেবাসেই হবে। এটা এক ধরণের জুলুম না?
অনেকে বলতে পারেন যে সহজ হলে সবার জন্যেই সহজ, আবার কঠিন হলে সবার জন্যেই কঠিন। কিন্তু, এইখানে কিন্তু আছে।
প্রতিবার ভর্তি পরীক্ষায় তুমুল লড়াই হয় পরিক্ষার্থীদের মধ্যে। দেখা যায় উত্তীর্ণদের মধ্যে একটা বিশাল অংশ গ্রাম-মফস্বল থেকে আসা। কিন্তু এবার মনে হয় তাদের অনেকেরই স্বপ্নভঙ্গ হতে যাচ্ছে।
কারণ, এই গ্রাম এবং মফস্বলের একটা বড় অংশের যথাযথ ডিভাইস এবং ইন্টারনেট কানেকশন নেই। তাই একটা বিশাল অংশ অনলাইন ক্লাস প্রস্তুতিমূলক ক্লাস করতে পারে নি। ফলে সিলেবাস কমপ্লিট করতে পারে নি। মূলত তাদের কথা চিন্তা করেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। এদিকে যারা ঢাকা বা বড় শহরে থাকে, তারা যথাযথভাবেই সিলেবাস সম্পন্ন করেছে। ফলে শহর আর গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হবে।
আবার, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের বোর্ড পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রায় এক বছর মেডিক্যাল ভর্তি প্রস্তুতির জন্য সময় পেয়েছিলো। আর সেখানে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সময় পাচ্ছে মাত্র ৩ মাস। ফলে পুরাতন ব্যাচ নতুন ব্যাচের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
তাই, সবদিক বিবেচনায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসেই ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস বলে ‘গেলো গেলো’ রব তোলার কিছু নাই। বাচ্চাগুলা এমনিতে যথেষ্ট সংকটে ছিলো গত দুই বছর। তাদেরকে নতুন সংকটে মধ্যে ফেলার অধিকার আমাদের নেই। সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য স্বপ্নভঙ্গের দায় কে নেবে?
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে ফিরছে। আশা করি তারা আগামী বছর এইচএসসি পরীক্ষা থেকে অ্যাডমিশন সব পূর্ণ সিলেবাসেই দেবে। কিন্তু এই বছর শুধুমাত্র মেডিক্যালে পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়াটা অন্যায্য সিদ্ধান্ত বলেই আমার মনে হয়।
লেখক: হাসান মাহবুব, ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট