সমন্বিত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা তরুণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কল্যাণ ও মর্যাদা নিশ্চিত করে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে। অধিকার রক্ষা, মূল্যবোধ তৈরি ও ক্ষমতায়নের পথ সুগম করতে সহায়তা করে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ, কর্মসূচি থাকলেও যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এখনও আমাদের সমাজে সেভাবে দেখা যায় না। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বলতে সাধারণভাবে বোঝায় কিশোর-কিশোরীদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা, বয়ঃসন্ধিকালের যত্ন, কিশোর-কিশোরীদের কম বয়সে যৌনতার ক্ষতিকর দিক, শারীরিক পরিবর্তন, পিরিয়ডকালীন জ্ঞান, অনিরাপদ যৌন মিলন, পরিকল্পিত গর্ভধারণ, বিয়ের উপযুক্ত বয়স, নিরাপদ মাতৃত্ব, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি নির্বাচন, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে সঠিকভাবে জানা-বোঝা, আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের পটভূমিতে এসআরএইচআর বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জনের চর্চা এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে থাকলেও শ্রেণিকক্ষে না পড়ানো, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ও শিক্ষকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা বিষয়ে ব্যাপক অসচেতনতা রয়েছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারসহ নানা কারণে নারীর প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে।
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এখনও এ বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন করে তুলতে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে আশার কথা, সরকারের সদিচ্ছার কারণে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ে মানুষ এখন আগের চেয়ে আরও বেশি সচেতন হয়ে উঠছে। এমনই পটভূমিতে গত ১১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচি ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির যৌথ আয়োজনে আমাদের দেশের পিছিয়ে পড়া নারীর অধিকার ও অবস্থা বিবেচনায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারবিষয়ক ছায়া সংসদের আলোকে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। বিভাগীয় পর্যায়ের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ইয়ুথ অ্যাডভোকেটরা মূলত এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের সচিব আলী নূর ও ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্। 'আর নয় নীরবতা বিতর্কে আসুক সচেতনতা'- বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য হলেও বিতর্কের ফাইনাল প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল- 'কেবল মাত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নয়, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষার অভাবে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে'। প্রতিযোগিতার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে গ্র্যান্ড ফাইনালে রংপুর বিভাগ ও ঢাকা বিভাগের বিতার্কিকরা অংশগ্রহণ করেন। এ আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করেছে 'রাইট হেয়ার রাইট নাউ বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্ম'।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত, পশ্চাৎপদ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অজস্র উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার এক অপূর্ণতা তাকে সর্বদা গ্রাস করেছে। এই কর্মবীর আরও বলতেন, বাংলাদেশের অর্জন অনেক। কিন্তু একটি বিষয়ে আমাদের পশ্চাৎপদতা যাবতীয় অর্জনকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করছে। আর সেটি হলো, জেন্ডার সাম্য অর্জনে আমরা প্রত্যাশিত সাফল্য দেখাতে পারিনি। আমাদের অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পিতৃতান্ত্রিকতা এখনও সামাজিক জীবনে শিকড় গেড়ে বসে আছে। স্বপ্ন পূরণ নিয়ে এই আক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে স্যার আবেদ বিমূঢ় চিত্তে বলেছিলেন, 'আমি আমার জীবনকালে হয়তো এটা দেখে যেতে পারব না।
সম্ভবত এটি আমার জীবনের অসমাপ্ত এজেন্ডা হিসেবে থেকে যাবে। অত্যন্ত দুঃখবোধ করি, যখন দেখি আজও নারীর ওপর পীড়ন ও নির্যাতনের অবসান হয়নি। এখন পর্যন্ত নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মজুরির বিনিময়ে বেশি কাজ করেন। এখনও কিছু নির্দিষ্ট পেশা ও কার্যক্রম থেকে পদ্ধতিগতভাবে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়; এখনও দেশে বহু মেয়ের বাল্যবিয়ে হয় এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। অথচ সমাজের উন্নয়ন ও পারিবারিক সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নারী-পুরুষের সমতা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি, এ দেশ অবশ্যই নারী-পুরুষ সমতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে এবং সমাজ প্রগতির পথে আমাদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।' আমরাও আশান্বিত হতে চাই, স্যার ফজলে হাসান আবেদের এই স্বপ্ন একদিন সার্থক হবে।
বাস্তব রূপ পাবে এ দেশে এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে নারী-পুরুষের অসমতা দূর করে নারীর মর্যাদা সুরক্ষা সম্ভব হবে। নারী তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবে। যদিও এ ক্ষেত্রে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বইতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও শিক্ষকরা ক্লাসে তা পড়াতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরিবার থেকেও কিশোর-কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারে না। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষার অভাবে বাল্যবিয়ে, শিক্ষা থেকে ঝরেপড়া, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, অনিরাপদ মাতৃত্ব, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ইত্যাদি ঘটছে অহরহ। দেশে এখনও গর্ভপাতজনিত কারণে ২১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়। তাই কিশোর-কিশোরীদের কম বয়সে যৌনতার ক্ষতিকর দিক, শারীরিক পরিবর্তন, পিরিয়ডকালীন জ্ঞান, অনিরাপদ যৌন মিলন ইত্যাদি সম্পর্কে মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া প্রয়োজন।
বস্তুত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার হলো মানবাধিকার। ২০১৬ থেকে ২০৩০-এর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়টি অধিকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কেননা, সমাজ ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব রয়েছে ব্যাপক। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ফলে বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার অনেকাংশে কমে এলেও প্রজনন স্বাস্থ্যনীতি ও কর্মসূচির বেশ কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। যেমন উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতি সেবার অভাবসহ চিকিৎসকদের মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী মেডিকেল সরঞ্জাম, ওষুধের ঘাটতি রয়েছে।
তাই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা বিষয়ে যেসব দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোকে মোকাবিলা করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদানের লক্ষ্যে ক্লাসরুমে পড়ানো ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে কিশোরী ও তরুণীদের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক ওরিয়েন্টেশনের আয়োজন, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করার লক্ষ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য প্রদান, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসআরএইচআর সম্পর্কিত ইয়ুথ ফ্রেন্ডলি তথ্য ও সার্ভিস প্রদানের ব্যবস্থা করা। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীবান্ধব শৌচাগার নিশ্চিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কর্মস্থলে বাংলাদেশ শ্রম আইনের আলোকে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পৃথক টয়লেট নিশ্চিত, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ মেয়েদের জরায়ু ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে গণমাধ্যমে আরও বেশি প্রচার করা। নিরাপদ মাতৃত্ব ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যচিত্র গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা; সর্বোপরি সমন্বিতভাবে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব জোরদার করা আজ অধিকতর প্রয়োজন। তাহলে নারী-পুরুষের সমন্বয়ে একটা সুস্থ ও স্বাস্থ্য সচেতন সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ, চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি