প্রতিভার মূল্যায়ন দরকার - দৈনিকশিক্ষা

প্রতিভার মূল্যায়ন দরকার

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী |

আমরা পৃথিবী বদলানোর কথা বলি। দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নেবার কথা বলি। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে গড়ে তোলার কথা বলি। কিন্তু একটা জায়গায় হয় আমরা এড়িয়ে যাই নতুবা সেখানে উদারতা দেখাতে পারি না। সেটি হলো প্রতিভার মূল্যায়ন ও তার লালন। কিন্তু এ জায়গাটিতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি উদার হবার প্রয়োজন ছিল। কারণ বর্তমান ও আগামী সময়ের প্রতিভাধর জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিভার ধারাবাহিক মূল্যায়নের সংস্কৃতি থাকা দরকার। এটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, যে জাতি প্রতিভা বা প্রতিভাধরদের মূল্যায়ন করতে পারে না সেখানে প্রতিভাধর মানুষদের জন্ম হয় না। বিষয়টি খুব গভীরভাবে ভেবে দেখার মতো। পৃথিবীতে সবাই ভালো সাহিত্যিক, ভালো বিজ্ঞানী, ভালো শিল্পী, ভালো অর্থনীতিবিদ হতে পারেন না। কিছু কিছু মানুষ তাদের অবদান আর কৃতিত্বের মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে উঠেন।

একজন মানুষ তার প্রতিভাকে কতটা সময় ধরে রাখবেন এটি নির্ভর করে তার কাজের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা গেছে কিনা তার উপর। এখানে রাষ্ট্র ও সমাজের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এখানে দুটি বিষয় বিবেচিত হতে পারে। এর একটি হলো প্রতিভার লালন, আরেকটি হলো প্রতিভাধরদের লালন। সময় ও পরিবেশ প্রতিভার লালন করলেও প্রতিভাধরদের লালন নির্ভর করে তাদের অবদান যতদিন দৃশ্যমান থাকে তার উপর। কিন্তু প্রতিভাধরদের লালন করার বিষয়টি এমন হওয়া উচিত নয়। কারণ একজন মানুষ যখন তার প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজকে সমাদৃত করতে থাকেন তখন তার নিজের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের বিষয়টি তিনি বিবেচনায় আনেন না। বরং তার ত্যাগ ও মেধাকে প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের উন্নয়নে ও মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেন। আবার একজন প্রতিভাধর মানুষ যদি অনেকদিন বেঁচে থাকেন তখন তার সমকালীন প্রজন্ম তাকে গুরুত্ব দিলেও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। এটি পরবর্তী প্রজন্মের অবহেলা বা অবজ্ঞা বলা যাবে না বরং প্রতিভা ও প্রতিভাধরদের লালন করার সংস্কৃতি আমাদের না থাকায় ও না জানার কারণে এমনটি ঘটে থাকে। ফলে অনেক প্রতিভাবান ও গুণী ব্যক্তিদের আমরা অবহেলায় মৃত্যুবরণ করতে দেখি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায় তা হলো প্রতিভা ও প্রতিভাধর মানুষ অনেক সময় আমাদের অজানা থেকে যায়। এ ধরনের প্রতিভাধর ব্যক্তিরা নিভৃতচারী মনোভাবের হয়ে থাকে। আমাদের দায়িত্ব হলো এ ধরনের প্রতিভাগুলোকে খুঁজে বের করে দেশের উন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজে লাগানো। কিছু শিল্প আছে যা বয়সের উপর নির্ভরশীল যেমন সংগীত শিল্পের শিল্পী, অভিনয় শিল্পের শিল্পী, ক্রীড়াঙ্গনের ক্রীড়াবিদ। তারা যতদিন অবদান রাখতে পারেন ততদিন পর্যন্ত তাদের সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে কিন্তু যখন তাদের বয়সের কারণে সৃষ্টিশীলতার সক্ষমতা থাকে না তখন সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিষয়টি এমন হওয়া উচিত নয়। বরং তাদের সময়কালীন প্রতিভার স্বীকৃতি আজীবন থাকা দরকার। একজন চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা পেলেও একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি সেটি পান না। কিন্তু এখন সময় এসেছে কিভাবে প্রতিভাধর মানুষদের অবদানকে লালন করে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদাকে বজায় রাখা যায়। এজন্য জাতীয় নীতিমালা প্রণীত হওয়া দরকার। যেখানে প্রতিভা সৃষ্টি, তার লালন ও প্রতিভাধরদের জীবনকে সুরক্ষিত করার কৌশল, পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন থাকবে।

অনেক গবেষক মনে করেন বয়সের সাথে প্রতিভার এক ধরনের দৃশ্যমান সম্পর্ক আছে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, অর্থনীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভাধর মানুষদের বিশ্লেষণ করে তারা বলছেন তারুণ্যে একজন মানুষের মধ্যে প্রতিভার যে বিকাশ ঘটে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা দ্রুত কমে যায়। এ কথাটি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও বিশ্বাস করতেন। তিনি মানুষের প্রতিভা আর বয়সের মধ্যে সম্পর্কের তুলনা করতে গিয়ে বলেই ফেলেছেন- ‘যে ব্যক্তি ত্রিশ বছর বয়সের আগে বিজ্ঞানে কোনো অবদান রাখতে পারেনি, সে আর কখনোই পারবে না’। যদি আমরা আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে বিষয়টি চিন্তা করি তবে দেখি ১৯০৫ সালটিকে তার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর বছর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ছাব্বিশ বছর। এই বিস্ময়কর বছরটিতে তিনি ব্রাউনীয় গতির উপর গবেষণা করে অনুর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। আলোর কনিকা বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব গবেষণাও এসময় সফল হয়েছে। ঠিক একই সময়ে তিনি সবচাইতে জনপ্রিয় আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বটি দিয়েছেন যা পৃথিবীর আগেকার সব ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। তার বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 যুক্তি, প্রমাণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে মাত্র তিন পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। এজন্য পরবর্তীতে তিনি নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে স্বীকৃতি অর্জন করেন। এই অভাবনীয় ও বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলোর পর তিনি আরো ৫০ বছর বেঁচে থাকলেও আর কোনো বড় ধরনের আবিষ্কার করতে পারেননি।

বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন মহাকর্ষ, আলোর বিচ্ছুরণসহ তার সফল এবং বিখ্যাত আবিষ্কারগুলো তরুণ বয়সেই করে ফেলেছিলেন। আরো পরিষ্কার করে বললে তার ২৪ বছর বয়সের মধ্যেই। ১৯৫৩ সালে এইচ.সি লেহম্যান তার গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন পৃথিবীর বেশিরভাগ সফল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো মূলত তরুণ বিজ্ঞানীরাই করেছিলেন, বয়স্ক বিজ্ঞানীরা নয়। ২০০৩ সালে সাতোশি কানাজাওয়া ২৮০ জন বিজ্ঞানীর ওপর তার গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখেন যে, বয়ঃসন্ধির সময় থেকে প্রতিভা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে যৌবনে তা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায় এবং ত্রিশ বছরের পর প্রতিভার বিকাশ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এ গবেষণাগুলো প্রমাণ করছে আমাদের দেশে যে তরুণরা রয়েছে তাদের ভিতরের প্রতিভাকে বের করে এনে তা দেশের উন্নয়নের কাজে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এ গবেষণাগুলো পুরোপুরি সত্য বলেও মেনে নেওয়া যায় না। কারণ, তরুণ বয়সে মানুষের মধ্যে আবেগ কাজ করে। এ আবেগ তাকে নতুন নতুন সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু এটির কোনো নেতিবাচক ফলাফল আছে কিনা তা ভাবার মত চিন্তাশক্তি তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে না। এটি অভিজ্ঞ প্রতিভাবান মানুষদের দ্বারাই চিন্তা করা সম্ভব হতে পারে। যেমন রবীন্দ্রনাথের বয়স যত বেড়েছে, তার সাহিত্যের উত্কর্ষতাও তত বেড়েছে। তবে গবেষণা যেটাই বলুক, সবকিছুরই ব্যতিক্রম আছে। আমরা চাই প্রতিভার অনুসন্ধান, প্রতিভাধরদের মূল্যায়ন ও জাতির ভিতরের মেধাশক্তিকে চিহ্নিত করে প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হোক।

 

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007436990737915