প্রসঙ্গ ডাকসু:গঠনমূলক রাজনীতিতে মুখরিত হোক ক্যাম্পাস - দৈনিকশিক্ষা

প্রসঙ্গ ডাকসু:গঠনমূলক রাজনীতিতে মুখরিত হোক ক্যাম্পাস

ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ |

গণতন্ত্রের বিকাশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। অথচ সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মুক্তবুদ্ধি চর্চার সূতিকাগার ডাকসু, চাকসু, জাকসু, রাকসু, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও কলেজগুলোয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, আবাসিক হল ও বিভাগগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ব্যাপারটি যখন সবাই প্রায় ভুলতে বসেছিল, তখন দীর্ঘ ২৮ বছর পর সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন— ডাকসু’ নির্বাচনের প্রয়োজন অনুধাবন করে। দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন এমনি এমনিই অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এর জন্য সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন করতে হয়েছে, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হয়েছে, আইনি জটিলতা কাটিয়ে উঠতে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সদিচ্ছা দেখাতে হয়েছে এবং সরকার সদিচ্ছা দেখিয়েছে। ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হলে আশা করা যায় অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেরও অর্গল ভেঙে যাবে।

সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব আর যোগ্য নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন ছাত্র সংসদ নির্বাচন। যোগ্য ও মেধাবী ভবিষ্যত্ রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বার্থে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি হলেও দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সাল বাদ দিয়ে ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে একজন সামরিক শাসক যে দৃষ্টান্ত রাখতে পেরেছেন, গণতান্ত্রিক সরকারগুলো তা পারেনি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশমান সময়ে নেতৃত্ব তৈরির কারখানা ছাত্র সংসদকে কেন অচল করে রাখা হচ্ছিল, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়, প্রতিভাবান ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, জাতির ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণী ভূমিকা পালন ও জাতি গঠনমূলক কাজে ছাত্র সংসদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছাত্র সংসদের নেতারা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ জাতির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ ধরনের নেতৃত্ব আর পাওয়া যায়নি ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণে।

কী কারণে দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ ছিল তা অনুসন্ধানে গেলে অনেক কিছুই হয়তো বেরিয়ে আসবে। তবে মোটা দাগে বলা যায়, নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা চান না ছাত্র সংসদ সচল হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ সচল করে তাদের একতরফা সুবিধাভোগের পথে বাড়তি ঝামেলা চায় না বলেই হয়তো দিনের পর দিন ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে নিরুত্সাহিত করে গেছে। অথচ এ সময়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘শিক্ষক সংসদ নির্বাচন’ কিন্তু ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষকরা তাদের অধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করলেও ছাত্রদের অধিকার আদায়ের পথটি করে রেখেছিলেন রুদ্ধ। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে এই রুদ্ধ দুয়ার খুলছে। এখন এই দুয়ার হবে অবারিত। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা যে কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাচ্ছিলেন না, সে কারণটিও অগণতান্ত্রিক।

রাজনীতি এখন চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। যে যত বড় ব্যবসায়ী, তিনি তত বড় নেতা। রাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে দেশসেবা আর ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে দেশসেবার মধ্যে তফাত্ আছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য রাজনৈতিক নেতা বেরিয়ে না আসায় রাজনীতি হয়ে গেছে কলুষিত। সুবিধাবাদী রাজনীতি প্রকট হয়েছে। টাকার বিনিময়ে নেতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানে-গরিমায় সমৃদ্ধ মানুষের রাজনীতিতে আগমনের ঝোঁক কমছে। শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হয়। অপর্যাপ্ত পরিবহন, লাইব্রেরিতে বই সংকট, হলে সিট না পাওয়া, হল ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার ইত্যাদি সমস্যা তাদের নিত্যসঙ্গী। ছাত্র সংসদ না থাকায় এসব সমস্যা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার কোনো মাধ্যম নেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর সুয়োগ নেই। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়েও শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই।

ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে বঞ্চিত হচ্ছিল তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে। এই দীর্ঘ সময়ে ছাত্র নামধারী নেতারা ছাত্রদের কল্যাণ করার পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত ছিল। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, ফাও খাওয়াসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল তারা। ছাত্র সংসদ সচল থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নামধারী বহিরাগতরা বিতাড়িত হতে বাধ্য হতো। ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল সোনালী সেই অতীত আবার পুনরুদ্ধার হতো। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দল পরিচালনায় যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্বের যে সংকট চলছে, তা দূর হতো।

প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য কী? আর অনেক ছাত্র সংগঠনে বছরের পর বছর নতুন কমিটি হয় না। অছাত্রদের দিয়ে চলে ছাত্র সংগঠন। স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির চেহারা কেমন হওয়া উচিত— এমন বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের অভিমত হলো, ছাত্র রাজনীতি তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসকরা টিকে থাকার জন্য ছাত্রদের দলে টেনে অস্ত্র ও অর্থ দিয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসকরা সরাসরি এই কাজটি করেছেন। ফলে ছাত্র রাজনীতি এখন আর ছাত্র রাজনীতিতে নেই। তারা লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। তারা ছাত্রদের বিষয় নিয়ে কাজ করে না। তারা এখন বিত্তবান, ক্ষমতাবান। মেধাবী ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতিতে নেই। সাধারণ ছাত্রদের রাজনীতির প্রতি তৈরি হয়েছে এক ধরনের অনীহা।

ছাত্র রাজনীতির নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের সময় এসেছে। পরাধীন ও স্বাধীন দেশে ছাত্র রাজনীতির চরিত্র কখনোই এক হতে পারে না। আসলে স্বাধীন দেশে ছাত্র রাজনীতি কেমন হবে, আমাদের নীতি-নির্ধারকরা তা নির্ধারণে গুরুত্ব দেননি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাশ পড়ে— শুধু এই জুজু দেখিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া সে ইঙ্গিতই বহন করে। বললে বেশি হবে না যে, নীতি-নির্ধারকদের গুরুত্বহীনতার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি এবং দিনের পর দিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র রাজনীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ছাত্র রাজনীতি হতে হবে স্বাধীন। তারা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। তারা ছাত্রদের নিয়ে কাজ করবে। তাহলে ছাত্র রাজনীতি আবার গৌরবের ধারায় ফিরবে। জাতির প্রয়োজনে তারাই মাঠে থাকবে।

বাংলাদেশে নেতৃত্বের সংকট কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। আরও শোনা যায়, ব্যবসায়ী ও আমলা দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভরে গেছে। বড় দুটি দলের নেতৃত্বেই এখন আমলা ও ব্যবসায়ীদের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ হলো তৃণমূল থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়া, সেটি বিকশিত ও পরিপক্ব হওয়ার প্রক্রিয়া থেমে গেছে। এ প্রক্রিয়ারই একটি হলো দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া।

১১ মার্চ ২০১৯ অনুষ্ঠিত হবে ডাকসু নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ ২৮ বছর পর আবার যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু হবে। ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হলে খুলে যাবে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দ্বার। ছাত্রদের গঠনমূলক রাজনীতিতে মুখরিত হতে থাকবে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিশ্বাস করেন, রাজনীতি যেমন একদিনে কলুষিত হয়নি, তেমনই একদিনেই সমাজে দুর্নীতি ডালপালা বিস্তার করেনি। যে বিষয়গুলো একদিনে ঘটেনি, সেগুলোকে নির্মূলের দ্রুত কোনো মাধ্যম নেই। দুদককে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমিয়ে আনা যাবে; কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, তাকে নির্মূল করবে কোন দুদক? এই প্রশ্নেরও উত্তর জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে জন্য তিনি যেখান থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি শুরু হয়, সেখান থেকেই শুরু করেছেন। ডাকসু নির্বাচন দিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দ্বার খুলে দিয়েছেন।

 

লেখক :শিক্ষাবিদ গবেষক।

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0092220306396484