প্রাইভেট কোচিং ও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান - দৈনিকশিক্ষা

প্রাইভেট কোচিং ও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

কোনো কোনো শিক্ষক মনে করেন, শিক্ষার্থীদেরকে তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়তেই হবে- এ মনোভাব পোষণ করার কারণে শিক্ষকগণ তাঁদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন। কোনো শিক্ষার্থী যদি শ্রেণিশিক্ষকের কাছে না পড়ে অন্যের কাছে প্রাইভেট পড়ে, শিক্ষক তা কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারেন না; বরং সব শিক্ষার্থীকে তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য বাধ্য করেন। যদি বাধ্য না হয় তাহলে তিনি বিভিন্ন মূল্যায়নে তাকে শায়েস্তা করতে কসুর করেন না।

শিক্ষকগণ প্রাইভেট পড়ানোর প্রত্যাশায় পাঠের বিভিন্ন অধ্যায় সময়মত ক্লাসে পড়াতে চান না। ফলশ্রুতিতে ক্লাস রুটিন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। একদিকে প্রাইভেট পড়া শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বরের সুযোগ পায়, অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী পড়তে পারে না তাদেরকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষকরে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় আভ্যন্তরীণ পরীক্ষক হিসেবে শিক্ষক উপস্থিত থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফেল করানো চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় অভিভাবকগণ ব্যথিত ও অসহায় হয়ে নিজ  সন্তানদের প্রাইভেট কোচিং এর টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হন।

বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এই প্রাইভেট পড়াকে কেন্দ্র করে স্কুলে স্কুলে শিক্ষকগণ মনস্তাত্ত্বিক লড়াই ও হিংসা-বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ছেন। যেসব বিষয়ের শিক্ষকগণ পড়ানোর সুযোগ পান না তাঁরা নানা অজুহাতে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী কোনো কারণে প্রাইভেট পড়তে পারে না, তাদের মধ্যেও এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও হতাশা বিরাজ করছে। তারা প্রাইভেট পড়তে না পারায় মনোবল হারিয়ে ফেলছে ও অনেকে পড়ালেখা ত্যাগ করছে।

ফলশ্রুতিতে স্কুলে প্রশাসনিক কর্ম ব্যাহত হচ্ছে ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। এসব বিষয় দেখে মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত প্রাইভেট পড়াটা শিক্ষার্থীদের জন্য দাসপ্রথায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরে আলাদাভাবে প্রাইভেট টিউশনের প্রয়োজন হবে কেন? এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ সরকার কেন নিচ্ছে না, যেখানে শিক্ষার্থীদের সমস্ত চাহিদা বিদ্যালয়েই পূরণ হয়ে যাবে, আলাদা করে প্রাইভেট পড়ার দরকার পড়বে না।

ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে- খেলার মাঠগুলোতে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা করতে দেখা যায় না। পড়া-লেখার রুটিন পালন করায় তাদের হাতে সময় থাকে না। স্কুল সময়ের আগে এবং পরে এমনকি স্কুল চলাকালীন সময়েও শিক্ষার্থীদের কোনো কোনো শিক্ষকের নিকট প্রাইভেট পড়তে দেখা যায়। সকল বিষয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের সঙ্গে জড়িত।

অভিভাবকরা তাদের অন্যান্য কাজ ফেলে ছেলেমেয়েদের আনা-নেয়ার পিছনে সময় দেন। এ কারণে অনেকে তাদের কর্মস্থলেও কম সময় দিতে পারেন। শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্থতা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করার কোনো তাগিত নেই। আফসোস! অভিভাবকমন্ডলী এ সমস্যা নিরসনে কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। কোনো কোনো অভিভাবক বিষয়টি নিয়ে খুবই হতাশ ও উদ্বিগ্ন।

বর্তমানে দেশব্যাপী চালু করা হয়েছে প্রাথমিক ও জুনিয়র মাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষা। আর সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রাইভেট টিউশনের দিকেই ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি গণসাক্ষরতা অভিযানের এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে অংশগ্রহণকারী শতকরা ৭৭ ভাগ শিক্ষার্থীই  প্রাইভেট টিউশন করতে বাধ্য হয়েছে। সরকারের অর্থে পরিচালিত বিদ্যালয়ে ৮০ শতাংশ, অনানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়গুলোতে ৫১ শতাংশ, কিন্ডারগার্টেনে ৬৯ শতাংশ, নতুন করে সরকারিকরণ করা প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ৭৮ দশমিক ৫ এবং ইবতেদায়ি মাদরাসায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করে থাকে। 

প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করতে পারলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে। কেননা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যয়ের বেশির ভাগই যায় প্রাইভেট টিউশন খাতে। প্রাইভেট টিউশনের অর্থ জোগাড় করতে না পারায় প্রাথমিক ধাপ শেষ করার আগেই শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ছে দরিদ্র পরিবারের অনেক শিশু। এ বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক বলেন, প্রাথমিকে শিক্ষা ব্যয়ের বড় অংশই যায় প্রাইভেট টিউশন আর কোচিং ফি বাবদ। এসব অর্থ জোগাতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়েই ঝরে পড়ছে। 

শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। বহু বিদ্যালয়কে জুনিয়র থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চ-মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। অথচ পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। উচ্চ-মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাবরেটরি নেই। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষক অবসর গ্রহণ করছেন; কিন্তু সে সমতা রক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। ফলে স্কুলে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।

এমন একটা শিক্ষার পরিকাঠামো এবং সার্বিক ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা দরকার- যেখানে শিক্ষার্থীরা স্রোতের মতো প্রাইভেট টিউশনের জন্য দৌড়াবে না, সে তার পাঠ গ্রহণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সম্পন্ন করতে পারবে। 

শিক্ষার মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। এতে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন ব্যবসা প্রতিরোধে কোনো রকম বিধান রাখা হয়নি। শিক্ষকরা ক্লাসে ঠিকমতো না পড়ালে বা ক্লাস ফাঁকি দিলে কী শাস্তি হবে সেই নির্দেশনাও রাখা হয়নি। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও বাতিল হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সরকারিভাবে বন্ধের আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। 

প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ এবং শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করার কথা বলছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলা ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অপর্যাপ্ততায় শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান হচ্ছে না। প্রাইভেট টিউশন সংকটের মূলে রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি মৌলিক সমস্যা। গুণগতমান বাদ দিয়ে সংখ্যাগত বিষয় নিয়ে সবাই ব্যস্ত।

সকলের আগ্রহ এখন শিক্ষার্থীকে কোন বিষয়ে কত নম্বর পেতে হবে তা নিয়ে। জ্ঞান যাতে নম্বরের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য এমন পদ্ধতি প্রবর্তন করা উচিত যেখানে জ্ঞানের পরীক্ষা হবে। যতদিন পর্যন্ত অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের ওপর চাকরির বাজারের ভয়াবহ প্রতিযোগিতা এবং বেশি নম্বরের উম্মাদনার চাপ শেষ না হবে ততদিন পর্যন্ত প্রাইভট টিউশনের ব্যবসা চলতেই থাকবে। এ সমস্যা নিরসনে শক্তিশালী মনিটরিং সিস্টেম চালু করা প্রয়োজন। 

এমতাবস্থায়, শিক্ষার্থীদের নির্বাক থাকা উচিত নয়। তাদের উচিত হেডমাস্টারকে এই বিষয়ে তাদের মনোভাব জানানো। তিনি যদি এই সমস্যা নিরসনে সক্ষম না হন, তবে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সাহেবকে জানানো দরকার। এর পরেও যদি প্রতিকার না হয় তাহলে তাদের নিজ নিজ অভিভাবককে সংঘবদ্ধ করে সামাজিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলে প্রতিবাদ জানানো দরকার। তবে কোনোক্রমেই শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষকের বিরাগভাজন হওয়া উচিত হবে না।

এ সম্পর্কে আমি একটি উদাহরণ দিতে পারি, জনৈক ইতিহাসের এম. এ. পাশ শিক্ষককে এক ছাত্র সাহস করে বলেছিল, “স্যার, আপনি বাড়ি থেকে ভালো করে ক্লাস নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসলে ভালো পড়াতে পারতেন। আর আমরাও উপকৃত হতাম।” ধন্য সেই শিক্ষার্থী, ধন্য তোমার সৎসাহস। আজকাল পড়াশোনায় আগ্রহী এমন ছেলে খুব একটা দেখা যায় না।

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন : পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042679309844971