শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি-এ বাক্যটি জন্ম থেকে জেনে আসছি। অথচ এই ঘাটতি দূরীকরণের ফলপ্রসু কার্যকর উদ্যোগ আজও গ্রহণ করা হয়নি। বিগত কয়েক বছর শিখন ঘাটতি দূর করার নামে বিশেষ করে প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের রমজান মাসে চলে অপতৎপরতা। তৃতীয় শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে প্রথম দিকে রোজা রেখে থাকেন। এ মাস এলে শিশুদের মাঝে রোজা রাখার প্রতিযোগিতা দেখা যায়। আরো দৃশ্যমান হয় সহিহ কুরআন কারিয়ানা শিক্ষা নিতে। বড়দের পাশাপাশি মসজিদের ছোট শিশুদের জামাতে নামাজের ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকে অতি নগণ্য। এর ফলে স্বল্প দিনের মন্ত্রণালয়ের মহতী উদ্যোগ শিখন ঘাটতি আরো বৃদ্ধি করে। সবার জন্য শিক্ষা না হয়ে কম সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য দায়সারা শিক্ষাদান হয়ে থাকে। রোজা রেখে স্বাভাবিক দিনের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষকদেরও একনাগাড়ে ৬-৭টা শ্রেণির কাজ করার বিষয়টি নীতি নির্ধারণী কর্তা ব্যক্তিদের উপলব্ধিতে আসছে না। তারা তাদের অফিসিয়াল কাজ আর শিক্ষাদানের একই মনে করেন।
ব্যাপক শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণে শিখন ঘাটতি বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের উপলদ্ধিবোধ জাগ্রত করার জন্য ছোট উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো, বাড়িতে এক বা একধিক ছোট শিশু খেলাধুলা দেখভাল তথা কখনো আগুনে, পানিতে বা দুঘর্টনার কবলে পড়ে সেদিকে পুরো পরিবার থাকে ব্যস্ত। নানা পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে অগণিত শিশুদের হৈ-চৈ, চিল্লাচিল্লি, খেলার স্থলে মারামারির মাঝে অবস্থান করে পাঠদান করাতে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষকেরা এ কাজ সার্বক্ষণিক করতে করতে কঠিন কাজটি অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন ৬-৭টা ক্লাস একনাগাড়ে করতে করতে শিক্ষকের মাথা গরম হয়ে অনেক সময় যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকেন। মাথা এতো গরম হয় অনেকটা খই, মুরি ভাজাসহ রান্নার করার মতো উপযোগী হয়ে থাকে। প্রাথমিকের বড় ধরনের শিখন খাটতি হয়ে থাকে শিক্ষক সংকটসহ কর্মরত শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। শিক্ষক সংকট প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে প্রতিমন্ত্রী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী জানান, গত একযুগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রধান শিক্ষক ৫ হাজার ২০৫ জন, সহকারী শিক্ষক ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৪ জনসহ মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৯ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাতে শূন্যপদে ২, ৩ বা ৪ বছর পর পর শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা শেষ করে বিদ্যালয়গুলো তাদের শূন্যপদে শিক্ষক পেয়ে থাকে। সংসদে প্রতিমন্ত্রীর প্রদত্ত বক্তব্য অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য হয়ে থাকে। অতীতে শিক্ষক নিয়োগের এ দীর্ঘসূত্রতায় শিক্ষকদের পদ শূন্যের ফলে চেয়ারে ধুলা বালি জমে যেমন বিবর্ণ হয়েছে, তেমনি শিক্ষক শূন্যতায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বিশাল শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তবে কিছুটা আশার আলো দেখা গেছে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগ পরীক্ষায়। এক বছর ৬ মাসের মধ্যে বিদ্যালয়ের শূন্যপদে বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাওয়ার সম্ভবনা বিদ্যমান। তিন-চার বছর পর পর শিক্ষক নিয়োগের ফলে শিখন ঘাটতির ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে উপলব্ধি জাগ্রত হওয়ার জন্য প্রাথমিকের মহাপরিচালককে ধন্যবাদ। এ প্রসঙ্গে শিক্ষক পদ শূন্য রাখার অভিপ্রায়ে জিরো টলারেন্সে নামিয়ে শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের নিয়ে দীর্ঘ প্যানেল প্রয়োজন। যাতে শিক্ষকের পদ শূন্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষক পায়, শিক্ষকের অভাবে শিখন ঘাটতি না হয়। বর্তমান তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতেও এক বছরের অধিক সময় অতিক্রম করেছে। এ দীর্ঘ সময়েও বিদ্যালয়ের শিক্ষক শূন্যতা কাম্য নয়। এ প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি ১ শাখা নং-০৫-১৭০-১১-০১৬.২২-৯৬ তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০২৩ পরিপত্রে সকল মন্ত্রণালায় অধীনে কর্মচারী নিয়োগে অপেক্ষমান তালিকা সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। সরকার মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এর অধীন সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর বা স্বায়ওশাসিত সংস্থা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে ১৩-২০ গ্রেডের পদে কর্মচারী নিয়োগে অপেক্ষমান তালিকা সংরক্ষণে নিম্নরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
অপেক্ষমান তালিকা প্রণয়নের সময় ডিপিসি পদের নিয়োগে যে জেলার জন্য প্রার্থী সুপারিশ করবে সেই জেলার যোগ্য প্রার্থীদের মধ্য হতে প্রতিটি সুপারিশকৃত প্রার্থীর বিপরীতে ১:২ অনুপাতে অপেক্ষমান তালিকা প্রণয়ন করবে। তবে অপেক্ষমান তালিকা প্রণয়ন করার সময় কোনো কোটার অধীনে কোনো জেলার যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট প্রাক্তন বৃহত্তর জেলার অন্তর্ভুক্ত কোনো জেলা হতে কোটার শূন্যপদ পূরণ করবে। কোটার শূন্যপদ পূরণ করা সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে যে জেলার চাকরিজীবীর সংখ্যা সর্বাপেক্ষা কম, সেই জেলার যোগ্য প্রার্থীদের মধ্য হতে মেধা ক্রমের ভিত্তিতে অপেক্ষমান তালিকা প্রণয়ন করতে হবে।
অপেক্ষমান তালিকা সংরক্ষণের মেয়াদ হবে বিবেচ্য বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে প্রথম নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের তারিখ হতে এক বছর অথবা শূন্যপদ পূরণের জন্য পরবর্তী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির প্রকাশের তারিখ যেটি আগে ঘটে।
নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত প্রার্থীদের মধ্যেই কেউ চাকরিতে যোগদান না করলে শূন্যপদ পূরণের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ডিপিসি সভায় অপেক্ষমান তালিকা এবং উত্তীর্ণ প্রার্থীদের রেজাল্ট সিট উপস্থাপনপূর্বক শূন্যপদে নিয়োগের জন্য প্রার্থী সুপারিশ করতে হবে। পাশাপাশি কমিটির উপস্থিতিতে অপেক্ষমান তালিকা হতে সুপারিশকৃত প্রার্থীকে তার নিয়োগের বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ অফিসের শূন্যপদে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। অথচ শিক্ষকের শূন্যতায় বিশাল ক্ষতি করে শিখন ঘাটতির। অভিভাবক সমাজের মনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়, যা মোটেই কাম্য নয়। এ প্রেক্ষাপটে খুব শিগগির প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে অপেক্ষমান তালিকা প্রয়োজন।
বিশাল নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিপুল সংখ্যাক মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেড। একই সমযোগ্যতায় অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন স্কেল কমপক্ষে দশম গ্রেড। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়ে অল্প সময় সরকারি বেসরকারি ব্যাংক-বিমাসহ নানা স্থানে উচ্চতর সুযোগ সুবিধা পেয়ে শিক্ষক তা পেশা ত্যাগ করে থাকেন। এ ছাড়া অবসর মৃত্যু ছাড়া নানা কারণে প্রতিনিয়ত শিক্ষকের পদশূন্য হচ্ছে। সারা দেশে প্রধান শিক্ষক বিপুল সংখ্যক পদ পদোন্নতির জটিলতার কারণে এক যুগের বেশি সময় শূন্য রয়েছে। এ জটিলতা নিরসনে শিক্ষকদের কর্মরত বিদ্যালয়ের সিনিয়রিটির ভিত্তিতে চলতি দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। বিগত সময় বিভিন্ন স্কুলে পোস্টিং নাম করে শিক্ষক নেতারা অসাধু কর্মকর্তাসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা দীর্ঘ সময় হতে স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা সারা দেশে প্রশংসার দাবি রাখে। শিখন ঘাটতি দূর করার জন্য সর্বাগ্রে প্রাথমিক শিক্ষক শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া জিরো টলারেন্স নামিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া তথ্য পত্রের চেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। শিক্ষকের পাঠদানে অবহেলা বা ত্রুটির জন্য কঠোর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকের কর্মচারীদের মতো শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি দূরীকরণের প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সর্বোচ্চ মন্ত্রী পর্যন্ত। শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কঠোর জবাবদিহিতা আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থার মতো স্বচ্ছ জবাবদিহিতা কাম্য। শিক্ষক সংকট দূরীকরণে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে প্যানেল ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে হবে। আর এর মাধ্যমেই দূর হোক প্রাথমিক শিক্ষাসহ সব শিক্ষার শিখন ঘাটতি।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ