প্রাথমিক শিক্ষকদের সক্ষমতা ও মূল্যায়ন - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষকদের সক্ষমতা ও মূল্যায়ন

উজ্জ্বল রায় |

‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’ এই শ্লোগানে শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্নিক ও আবেগ-অনুভূতির বিকাশ সাধন এবং তাঁদের দেশাত্মবোধ, বিজ্ঞান মনষ্কতা, সৃজনশীলতা ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করাই হলো প্রাথমিক শিক্ষা। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়াই হলো শিক্ষকদের দীক্ষা। আর শিক্ষকদের দীক্ষা দেয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত তারাই হলেন কর্তা বা কর্মকর্তা। মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে দরকার মানসম্পন্ন  পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল। আর সে কৌশল প্রণয়নে মাঠ পর্যায় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল স্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই হয় মানসম্মত পরিকল্পনা।

সারাদেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক প্রায় ৪ লাখ। এই শিক্ষকদের সবারই গুরু দায়িত্ব মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন করা। এদের মধ্যে যোগ্যতা, দক্ষতা, ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয়া সরকারি শিক্ষকরাই বেশি। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের দুরদর্শী সিদ্ধান্তে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমে আত্তীকৃত শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে আমাদের কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছেন এবং ছিলেন বলে মনে করি। একটা মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় কর্মরত শিক্ষক আছেন ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতায় নানা রকমের এবং বিচিত্র নামে; যা বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। যেমন: রাজস্বখাতভুক্ত শিক্ষক, প্রকল্পভুক্ত শিক্ষক, জাতীয়করণকৃত শিক্ষক, পুল শিক্ষক, প্যানেলশিক্ষক, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক, পরিক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি! সবার কাজ এক ও অভিন্ন; কিন্তু মানে আর নামে শুধু ভিন্নতা আছে। আর একই স্তরের শ্রেণি, বই, সিলেবাস অনুসরণ করে পাঠদান করা পরিক্ষণ বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন (১০গ্রেড) সম্পুর্ণ আলাদা।

প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সম্মানিত কর্তৃপক্ষ এসব অসম যোগ্যতার বিচিত্র নামধারী শিক্ষকদের এককাতারে এনে মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে, পাঠ্যবই, শ্রেণি রুটিন, পাঠপরিকল্পনাসহ প্রাথমিক শিক্ষা স্মার্টনেস করার জন্য অনলাইন ভিত্তিক (ই-প্রাইমারি) নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে তা সফলতার সাথে শেষ করে চলেছেন। 

সবার সদয় দৃষ্টিগোচর করতে জানাতে চাই, কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক শিক্ষায় দেয়া অনলাইন সফটওয়্যার যেমন, E-primary, PEMIS, PESP উপবৃত্তি, অনলাইন শিক্ষক বদলিসহ বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরি করে শিক্ষকদের মতামত বা অংশগ্রহণ না নিয়ে সেটা বাস্তবায়নের ডেডলাইন দিয়ে হঠাৎ করে একটা চিঠি বা অফিসআদেশ জারি করেন, কিন্তু কখনো ভাবেন না এই সফটওয়্যার সম্পর্কে তাঁদের শিক্ষকদের  কত শতাংশ দক্ষ বা বাস্তবায়নে তাদের সক্ষমতাই বা কতটুকু! তবুও অযোগ্য অদক্ষ আধো আধো প্রযুক্তি জানা শিক্ষকরা সেটা আয়ত্ত্ব করে বা কেউ কেউ বাইরে থেকে অন্যদের সহায়তায় নির্ধারিত সময়েই কাজটা করে দেয়। (এখানে বলে রাখি ১৪ দিনের আইসিটি ট্রেনিং দেয়া হয়েছে দেশের কতিপয় শিক্ষকদের এবং অনলাইনে কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যা শিক্ষক সংখ্যার তুলনায় সামান্য) কিন্তু কখনো দেখা যায়নি সুযোগ্য কর্তৃপক্ষ এ সফলতার জন্য শিক্ষকদের আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ দিয়েছে। আমাদের সুযোগ্য কর্তৃপক্ষের জানা আছে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে প্রযুক্তি জ্ঞান না থাকা অদক্ষ শিক্ষকরা জুম,  গুগলমিট ব্যবহার করে অনলাইনে পাঠদান করে শিক্ষার ধারাবাহিকতা চালিয়ে নিয়েছে এবং সেখানেও সফলতা আমাদের ডিপিইর ঘরেই উঠেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ সফলতার জন্যও আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকদের ধন্যবাদ দিয়েছে বলে জানা নেই। 

বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষা ৫ম শ্রেণির পাঠ সমাপনী পরীক্ষা যা ‘ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা’ নামে পরিচিত। যেখানে কোনো বোর্ড বা আলাদা কোনো দপ্তর নেই কিন্তু এই বৃহৎ পরীক্ষা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রাথমিকের এই শিক্ষকরাই  প্রশ্ন করা, পরীক্ষা নেয়া, খাতা দেখা, নিরীক্ষাসহ যাবতীয় কাজ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে মাত্র এক মাসের মধ্যেই ফলাফল তৈরি করে থাকে। কিন্তু সেখানেও শিক্ষকদের সক্ষমতার জন্য  ধন্যবাদ দিতে দেখা যায় নি। আর বিগত বছর অর্থাৎ সম্প্রতি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১৫ দিনের নোটিসে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেয়া হয়েছে, এখানেও শিক্ষকদের ভূমিকা দৃশ্যমান এবং শিক্ষকদের সক্ষমতাই সফলতা বলে মনে করি। 

এখন প্রশ্ন হলো, প্রাথমিক শিক্ষার সফলতা নির্ভর করে মূলত: শিক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো পরিকল্পনা বা আদেশ মাঠ পর্যায়ে যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, ডিপিই কর্তৃপক্ষ সেসব পরিকল্পনা গ্রহণে কখনো শিক্ষকদের মতামতকে গুরুত্ব দেন না বা মতামত নেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না! আমি মনে করি প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্থক ও ফলপ্রসু করতে হলে যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণে কর্তৃপক্ষের সাথে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে শিক্ষক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ বা অনলাইনে মতামত নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কল্যাণকর হবে এবং বাস্তবায়নে সফলতা আসবে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক না কেন সেটা বাস্তবায়নে কিন্তু মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকদেরই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। আজকের প্রেক্ষাপটে তাই একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রাথমিকে নানা নামের বিচিত্র যোগ্যতার শিক্ষক থাকলেও দক্ষ-অদক্ষ সমন্বয় করে এই শিক্ষকরাই কিন্তু তাঁদের জানা না-জানার মধ্যে নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রাপ্তির খাতা হিসাব করলে দেখা যাবে, এই শিক্ষকরাই স্বল্প বেতনে নানা বৈষম্য মোকাবেলা করে চাকরিতে যোগদান করে কোনো প্রকার পদোন্নতি ছাড়া দীর্ঘদিন কাজ করে কর্মজীবন শেষ করছেন। 

পরিশেষে বলবো, প্রাথমিক শিক্ষকদের সক্ষমতাকে সম্মান ও মূল্যায়ন করে প্রাথমিক শিক্ষায় যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা প্রাথমিক শিক্ষকদের মতামত নেয়া হোক; তবেই প্রাথমিক শিক্ষা হবে সার্থক, ফলপ্রসু এবং কার্যকর।     
লেখক: সহকারী শিক্ষক, লোহাগড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়

আগের নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক নিয়োগের দাবি - dainik shiksha আগের নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক নিয়োগের দাবি শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ - dainik shiksha শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ মাদকের গডফাদারদের ধরার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার - dainik shiksha মাদকের গডফাদারদের ধরার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার শিক্ষা প্রশাসনে বদলি আতঙ্কে নাহিদ-দীপু সিন্ডিকেটের ৯২ কর্মকর্তা - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বদলি আতঙ্কে নাহিদ-দীপু সিন্ডিকেটের ৯২ কর্মকর্তা দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষের হাতাহাতি, সভা পণ্ড - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষের হাতাহাতি, সভা পণ্ড শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রসর সমাজ তৈরির লক্ষ্যই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন - dainik shiksha অগ্রসর সমাজ তৈরির লক্ষ্যই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050890445709229