স্বাধীনতার পর এই উনপঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জন নেহাতই কম নয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া—সবকিছু মিলিয়ে বলা হয় যে ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। কিন্তু এর পরও প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই কি উন্নয়ন হচ্ছে আমাদের দেশে? দৈনন্দিন জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় এই প্রশ্ন বারবার মনে উঁকি দেয়। যেমন গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় যখন দেখি ফিটনেসবিহীন গাড়ি যাতায়াত করতে থাকে, অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত স্থাপনা পরিবেশের বারোটা বাজায়, সামাজিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে, তখন মনে হয় শুধু জিডিপি বৃদ্ধি মানেই কি ‘উন্নয়নের মহাসোপানে আমরা’? রোববার (৫ জানুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, আমার কাছে দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন হচ্ছে প্রতিটি নাগরিকের ভালো থাকা এবং সেটা অর্জনের প্রথম ধাপ হচ্ছে রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলোর সুরক্ষা দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে মৌলিক অধিকারের বিষয়ে অনেকক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশের একজন মন্ত্রী অসুস্থ হওয়ার পর সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিত্সা নিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের যে কোনো নাগরিক কি সেই একই রকম চিকিৎসাসেবার সুযোগ পাচ্ছেন? উত্তরটা সবারই জানা।
চারদিকে অসংগতি, অনিয়ম চোখে পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সিন্ডিকেট নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যকে ‘অমূল্য’ বানিয়ে ফেললেও সাধারণ মানুষের কিছুই করার থাকে না। কিন্তু এই ‘সাধারণ মানুষই’ তো দেশের মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ। দেশের আর্থসামাজিক পরিবেশ যদি এমন হয়, যেখানে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি ও সমস্যায় জর্জরিত জীবন কাটাতে হয়, তাহলে আমাদের এখন পর্যন্ত যা অর্জন, তা সত্যিকারের সুফল বয়ে আনবে না। ভুটানে Gross Domestic Product-এর পরিবর্তে Gross Domestic Happiness-কে উন্নয়নের সূচক হিসেবে ধরা হয়েছে। একটি অতি দরিদ্র দেশ থেকে তাদের আজকের এই বিবর্তন চোখে পড়ার মতো। আর তাদের এই ব্যতিক্রমী সূচকই প্রমাণ করে যে জনগণের ভালো থাকাটাই সত্যিকারের উন্নয়ন। আর আমাদের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সাহায্য প্রদানকারী দেশ হচ্ছে জাপান। জাপানের উন্নয়নের পেছনে মূল অনুঘটক হচ্ছে জাপানিদের নৈতিক শক্তি ও মূল্যবোধ। এমনকি তাদের প্রাথমিক শিক্ষাক্রমেও নৈতিক শিক্ষা একটি বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে।
আমাদের দেশেও এখন সবার আগে প্রয়োজন নৈতিক শক্তি ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতি নজর দেওয়ার পাশাপাশি জাতিগতভাবে যাতে নৈতিকতা অর্জন করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করা। যেমন নৈতিক শিক্ষা আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জাপান আমাদের জন্য একটি বড়ো রোল মডেল। একটি বিনয়ী, উদ্যমী এবং নৈতিক শক্তিতে উজ্জীবিত জাতি হিসেবে অবশ্যই তারা অনুসরণযোগ্য। আমরাও যদি তাদের এই গুণগুলো নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারি, তবে জাতি হিসেবে আমাদের উত্থানও অনিবার্য। তখন ‘সোনার বাংলা’ আর ‘সোনালি অতীত’ হয়ে থাকবে না, বরং অচিরেই তা বাস্তব হয়ে ধরা দেবে।
নূর-ই-জান্নাত নুশা : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।