বঙ্গবন্ধুর কাছে শিক্ষক সমাজের ঋণ - দৈনিকশিক্ষা

বঙ্গবন্ধুর কাছে শিক্ষক সমাজের ঋণ

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে বাঙালি আজ সারাবিশ্বে পরিচিত। ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জনসহ স্বজন হারানোর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে অভ্যুদয় হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের নাগরিকরা স্বাধীনতার স্বাদের পরিবর্তে পেয়েছে বৈষম্য ও বঞ্চনা। ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালির ওপর নির্যাতন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মাতৃভাষার জন্য সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র, জনতা শহিদ হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির চক্রান্তে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বাঙালি ভোটে জিতলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের আন্দোলনে ৬২, ৬৬ ও ৬৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাণ দেয় অগণিত বাঙালি।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করে উন্নয়ন করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের অংশে। বাঙালির স্বাধিকার, বৈষম্যকে ঘিরে দানা বাঁধতে শুরু করে ৬ দফা আন্দোলন। বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের বিরাট সময় কারাগারে ছিলেন। তাঁকে মেরে ফেলার অভিপ্রায়ে দেয়া হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বাঙালি জাতি সংগ্রাম করে তাদের প্রিয় নেতাকে মুক্ত করেন। পুনরায় ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি। বরং শুরু করে নির্বিচারে বাঙালি নিধন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ বিভীষিকাময় কালো রাত পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। অসংখ্য ভবন জ্বালিয়ে দেয়। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘর-বাড়ি, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। জীবন রক্ষার্থে প্রায় ১ কোটি লোক প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয়। তখনকার সময়ে বাঙালির কণ্ঠে আওয়াজ ছিল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল তখনকার বাঙালির ধমনীতে।

ভারত সরকারের সহযোগিতায় অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নিয়ে এদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষকসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে আমরা অর্জন করি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। সেদিন রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তিবাহিনী নামে স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় ঘৃণ্যচক্র পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে হত্যা, লুন্ঠন কাজে সাহায্য করে। সে সময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি বাঙালি জাতির জনককে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেদিন তাদের উপলব্ধি হয়েছিল- এক মুজিবকে হত্যা করলেও বাংলার ঘরে ঘরে কোটি কোটি মুজিব সেনা জন্ম লাভ করেছে।

অবশেষে আমাদের প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসেন। তিনি এসে দেখলেন, চারিদিকে শুধু ধ্বংসস্তুপ। ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। 

বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের অভাব দূরীকরণে সারাদেশে অগণিত রেশন শপ, ন্যায্য মূল্যের দোকান খোলার মাধ্যমে মানুষের চাহিদা পূরণ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগার ছিল শূন্য। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী টাকা লুট করে অগ্নিসংযোগ করে। রাস্তাঘাট, রেলপথ এককথায় তখনকার সময়ে সারাবাংলার অবকাঠামো ছিল ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রেডক্রস থেকে প্রাপ্ত টিনের সাহায্যে সংস্কার করা ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এ ভয়াবহ অভাবের মাঝে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর লুকিয়ে থাকা ঘৃণ্য দোসররা প্রতিদিন খাদ্যের গুদাম, পাটের গুদামে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত।

এ সময়ে প্রাথমিকে শিশু শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত গুড়া দুধ, ছাতু, বিস্কুট, খাতা, পেন্সিল, বই, জামা কাপড়, কম্বল বিনামূল্যে পেত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পেয়েছিল ন্যায্য মূল্যে টঙ্গির অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের কাপড়। ঢাকা শহরে রেশন কার্ডের দুর্নীতিরোধে প্রত্যেক এলাকা কারফিউ দিয়ে রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে তা দূর করা হয়। দেশের এ ভয়াবহ অবস্থায় এ মহানায়কের স্বপ্ন ছিল কীভাবে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা যায়। তাঁর স্বপ্নপূরণে ভাবনায় আসল তৃণমূলের গরিব, মেহনতি মানুষসহ সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।

শূন্য কোষাগার, ভয়াবহ অভাবের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিলেন। তাঁর মতো মহামানব বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছাড়া কারো পক্ষে এমন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা পান দেড় লাখ প্রাথমিক শিক্ষক। তিনি গ্রামগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষকদের অর্থনৈতিক দুর্দশার চিত্র স্বচক্ষে দেখেছেন। প্রতি হাট বারে পোস্ট অফিসের পিয়নের মাধ্যমে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বেতনের টাকা দেয়া হতো। তখনকার প্রাথমিক শিক্ষকরা ছিলেন সমাজে অসহায়, হতদরিদ্র। 

প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণের মাধ্যমে গরিব, খেটে খাওয়া, মেহনতি মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অপরদিকে শিক্ষকদের প্রতিও তাঁর হৃদয়ের গভীর মমতা-শ্রদ্ধা নিদর্শন সৃষ্টি করেছে। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি ক্ষমতায় থেকে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতির আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি এ বাস্তবতা অনুধাবনের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট শাহাদাত বরণের পর শিক্ষাখাত উন্নয়নের বদলে পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু আর কিছু সময় ক্ষমতায় থাকলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারিকরণ করতেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সব পর্যায়ের শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা পেতেন।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশাল অর্জন সৃষ্টি করে দেশে-বিদেশে সবকে হতবাক করে দিয়েছেন। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণির বই বিনা মূল্যে বিতরণ, ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণসহ অসংখ্য অর্জন রয়েছে তাঁর। তবে অসংখ্য অর্জনের মাঝে আজও প্রাথমিক শিক্ষা খুঁড়ে খুঁড়ে অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে বিরাজমান বৈষম্যের ফলে। 
প্রাথমিকের সঙ্গে বেসরকারি বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা ও বইয়ের বিশাল ব্যবধান: বিশেষকরে প্রাথমিক বিদ্যালেয়র বিশাল অমানবিক সময়সূচির ফলে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণের পদক্ষেপের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। এর ফলে জনগণ ছুটছে তাদের সন্তানদের বেসরকারি বা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে। সরকারের উপবৃত্তি, খাবার সবকিছু যেন সফলতার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাথমিকের সময়সূচি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ১ম-৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধ করার পদক্ষেপ যদি সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যকর না হয়, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-সংকট চরম আকার ধারণ করবে।

প্রাথমিকের সহকারি শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড, প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড নিয়ে সময়ক্ষেপণ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বিশাল চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক নেতারাসহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সবে মিলেমিশে সময়ক্ষেপণের কাজ এক সঙ্গে করে যাচ্ছে। আর সময়ক্ষেপণ না করে শিক্ষকদের বৈষম্য, সব শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ব্যবস্থা (সময়সূচি, বই ও আদর্শ মূল্যায়ন) চালু করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সরকারিকৃত বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব সংকটের হাত থেকে রক্ষা করুন।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থি সব কাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ। উন্নয়নের শিখরে অবস্থান করুক আমাদের এ স্বাধীন বাংলাদেশ। সব প্রাথমিক শিক্ষকদের বঙ্গবন্ধুর রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করার আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারী না করলে আজও হয়তো তারা অন্যান্য শিক্ষকদের মতো বেসরকারি থাকতো। জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের শক্তির। বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রাথমিক শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রাধানমন্ত্রীর উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। 

মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিকশিক্ষা ডটকম।

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003960132598877