বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছাত্র রাজনীতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। স্বাধীনতার পূর্বে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এমনকি ’৭০-এর নির্বাচনে ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ এবং সামগ্রিকভাবে জাতিকে একটি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি ছাত্ররাই করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলার ছাত্রসমাজ জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন মূলত এই ছাত্রসমাজকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে। সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের মতো ছাত্র রাজনীতির কিংবদন্তিরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে করেছেন সমৃদ্ধ। কিন্তু সময়ের পথ পরিক্রমায় আজকে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি আপন ঐতিহ্য হারিয়ে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা বন্ধ হয়ে গেলেও ছাত্র রাজনীতি তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ছাত্র রাজনীতির আতুরঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুজিববাদী ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন; পরবর্তীতে ছাত্রদল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান ছিল। ৭২, ৭৯, ৮০, ৮৯, ৯০ সালে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের প্রার্থীর বিপরীতে নির্বাচন করে মাহমুদুর রহমান মান্না (১৯৭৯, ১৯৮০) আখতারুজ্জামান (১৯৮২), সুলতান মোহাম্মদ মনসুর (১৯৮৯), আমানউল্লাহ আমান (১৯৯০) ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দীর্ঘ ২৮ বছর দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিরাজ করলেও ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের আমল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু হয়। চলতে থাকে ক্যাম্পাস দখলের প্রতিযোগিতা। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে।
সর্বশেষ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ক্যাম্পাস গুলো ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্বে চলে যায়। ৯১ থেকে চলে আসা চর্চা অনুযায়ী অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হলে থাকা তো দূরের কথা ক্যাম্পাসে ক্লাস, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর এবছর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্নবিদ্ধ এই নির্বাচনে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও অবস্থান নিতে দেখা যায়।
অনেক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম এবং গেস্টরুম সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের প্রতি অনুগত না থাকলে এবং তাদের সভা-সমাবেশ-মিছিল অংশ না নিলে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের খবর আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি, মারধর, প্রশ্ন ফাঁস এমনকি গুলিতে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নাম বারবার এসেছে সামনে। ডাকসুর ভিপি থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা অতি সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার কথা আমরা সবাই জানি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট দীর্ঘদিনের। হলগুলোতে সিট বরাদ্দ দেয় ছাত্রলীগ- এ কথা ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও স্বীকার করে। সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি এখন প্রকাশ্য বিষয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় হলগুলোতে বহিরাগত এবং অছাত্রদের সংখ্যা অনেক বেশি। গণরুমগুলোতে সিট পাবার শর্ত হিসেবে ছাত্রদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশে উপস্থিত থাকতে হয়। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (সদ্য সাবেক) গোলাম রাব্বানীকে প্রটোকল না দেয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের চারটি রুমে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে ওই রুমগুলোর ছাত্রদের সারারাত বাইরে অবস্থান করতে হয়।
সম্প্রতি রোকেয়া হলে কর্মচারী নিয়োগে ২১ লাখ টাকা নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে রোকেয়া হল ছাত্রলীগের চারজন নেত্রীর বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে তিনজন ডাকসু ও হল সংসদের সদস্য। তাদের সঙ্গে এই অনৈতিক কর্মকান্ডে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদার সম্পৃক্ততার কথা উঠে এসেছে। এই অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করায় প্রাধ্যক্ষ এবং অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাদের দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন ওই হলের আবাসিক ছাত্রী শ্রবণা শফিক দীপ্তি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা গণরুমে মানবেতর জীবনযাপন করে। অথচ অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও টিভি, ফ্রিজ ব্যবহার করেন এবং চারজনের রুমে একা থাকেন। কারো কারো ক্ষেত্রে একাধিক রুম এককভাবে ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়। গণরুম ব্যবস্থা বাতিল করা এবং আবাসন সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত জিএস গোলাম রাব্বানী সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পারলেও নিজের কক্ষে এসি লাগিয়েছেন। তার ব্যক্তিগত কক্ষে শুভাকাক্সক্ষী বড় ভাইয়ের উপহার দেয়া এসি লাগানো হলেও ভিপি, এজিএসের কক্ষে কোন এসি লাগানো হয়নি। ডাকসুর জিএস এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (সদ্য সাবেক) গোলাম রাব্বানী তার রুমে ডাকসুর কোষাধক্ষ্য বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামকে অবহিত করে এসি লাগিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। মজার বিষয় হলো ডাকসুর মাননীয় কোষাধ্যক্ষ মহোদয়কে আগস্ট মাসে লাগানো এসির ব্যাপারে সেপ্টেম্বর মাসে জিজ্ঞেস করলে, তাকে জানানো হয়েছিল কিনা সেটি ভুলে গেছেন বলে জানান। ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমার্স বর্তমান বিশ্বে একটি পরিচিত রোগ। মাননীয় কোষাধ্যক্ষ মহোদয় এমন কোন একটি ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত হতেই পারেন। তবে সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে জনাব অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করলে তার ওপর শারীরিক এবং মানসিক চাপ বাড়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেদিকে নজর দিবেন বলে আমরা আশা করি।
৬ মাস পেরিয়ে গেলেও ডাকসুর কার্যক্রম মূলত স্থবির হয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর, জিএস গোলাম রাব্বানী, এজিএস সাদ্দাম হোসেনসহ ডাকসুতে ছাত্রলীগের ২৩ জন প্রতিনিধির অসহযোগিতার অভিযোগ করে আসছেন শুরু থেকেই। এদিকে ভর্তির নীতিমালা না মেনে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতাকে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স বিভাগের মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট এর সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রামে ভর্তি হবার সুযোগ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে আটজন ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন এবং সাতজন নির্বাচিত হন। জানা যায় উপাচার্য ও ডিনের স্বাক্ষরকৃত চিরকুটে ছাত্রলীগের নেতারা ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য এবং ওই বিভাগের ডিন কেউই এ ব্যাপারে কিছু জানেন না এবং তারা ভর্তির সুপারিশের কোন চিরকুট দেননি বলে জানিয়েছেন। দুঃখের ব্যাপার হলো, এই সব কিছুর পরও তাদের ভর্তি বাতিল বা অন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্যের বাড়িতে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের হামলা’ হলে উপাচার্য মহোদয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেয়ার পূর্বে তাকে রক্ষা করবার জন্য ছাত্রলীগকে খবর দেন। এভাবে বর্তমানে ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।
এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (তৎকালীন ইকবাল হল) স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি হয় ছাত্রলীগের হাতে। কলাভবনের বটতলার গাড়ি বারান্দার ছাদে প্রথম সেটি উত্তোলন করা হয় তৎকালীন ডাকসুর ভিপির হাতে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের পাশের সবুজ লনে ছাত্রলীগের বর্ধিত এক সভায় আফতাব উদ্দিন আহমেদ, শহীদ চিশতী হেলালুর রহমান এবং রায়হান ফেরদৌস মধুর কণ্ঠেই প্রথমবার জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এবং ডাকসুর তৎকালীন নেতাদের দ্বারাই গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এত এত গৌরবের, অহংকারের ছাত্র সংগঠন এবং বাংলাদেশের গৌরবময় রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ তার গৌরব এবং ঐতিহ্য হারিয়ে শিক্ষার্থী এবং দেশের সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ এ প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং-২০২০ এ বিশ্বের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও স্থান করে নিতে পারেনি; যেখানে ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থী অভিভাবক এবং সাধারন জনগণের কাছে ছাত্রলীগ তার গ্রহণযোগ্যতা বহুলাংশে হারিয়েছে। এতকিছুর পরও এদেশের মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডাকসু এবং ছাত্র রাজনীতিকে ঘিরেই আগামী দিনের সুস্থধারার রাজনীতি চর্চার স্বপ্ন দেখে। সকলের প্রত্যাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রলীগ এবং ডাকসুর প্রতিনিধি হয়ে আবারো একদিন সিরাজুল আলম খান, আসম আবদুর রব, তোফায়েল আহমেদ, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের মতো ছাত্র রাজনীতির নতুন কিংবদন্তিদের জন্ম হবে। দেশের ছাত্ররাজনীতি সুস্থধারায় ফিরে আসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিরবে তার পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে, এ দেশের মানুষের গর্ব হয়ে, আস্থার কেন্দ্রস্থল হয়ে।
লেখক: সাকিব আনোয়ার