শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকের প্রায়োগিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এবং প্রশিক্ষণকে অর্থবহ করতে প্রচলিত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সমন্বয় করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করানোর জন্য কিংবা কার্যকর শিখনের জন্য সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন উপাদন হলো শিক্ষক। কিন্তু দেখা যায়, শিক্ষকের যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে শিক্ষার্থীর উন্নয়ন পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয় না। আবার প্রশিক্ষণ উপকরণ, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণের মান ইত্যাদির ন্যূনতার কারণেও শিক্ষকের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ব্যাহত হয়। একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু ও কার্যকর শিখন-শেখানো কৌশল সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। তাই পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে শিক্ষার্থীকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে শিক্ষণ প্রশিক্ষণের মডেল সবসময় পরিবর্তন ও পরিমার্জনের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য প্রথম এক বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন (সিইনএড) চালু হয় স্বাধীনতারও আগে। এরপর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতিতে সিইনএডকে আরো যুগোপযোগী করে ১৮ মাস মেয়াদি ডিপিএড কোর্সের চালুর কথা বলা হয়। সে অনুযায়ী, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ মাস মেয়াদি সিইনএডের পরির্বতে ১৮ মাস মেয়াদি ডিপিএড কার্স চালু করা হয়। এরপর থেকে ১০ বছরের বেশি সময় পরীক্ষামূলকভাবেই কোর্সটি পরিচালিত হয়। অবশেষে অনেক সমালোচনার মুখে নতুন শিক্ষাক্রমকে গুরত্ব দিয়ে ডিপিএডকে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য প্রণীত করা হয়েছে ১০ মাসব্যাপী মৌলিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি (বিটিপিটি)। এই মৌলিক প্রশিক্ষণ কোর্সটি সম্পূর্ণ ট্রেনিং মুড বা অনুশীলনমূলকভাবে পরচালিত হবে। এতে চারটি মডিউলকে মোট ১৯টি উপমডিউলে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষক্রম রূপরেখা-২০২১ ও জাতীয় শিক্ষক্রম-২০২২ এর আলোকে প্রত্যেকটি মডিউল প্রণয়ন করা হয়েছে। মডিউলগুলোতে একুশ শতকের দক্ষতাসমূহ বিশেষত সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতাসহ শিশুর সৃজনশীল ও সামাজিক দক্ষতার বিকাশ ও অনুশীলনের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। এতে প্রাক-প্রাথমিক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কাব-স্কাউস্টিং, শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষাসহ শিক্ষকের পেশাদারিত্ব, জবাবদিহিতা ও অঙ্গীকার বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকতা পেশায় শিক্ষাক্রম, শিখন-শেখানো পদ্ধতি এবং মূল্যায়ন সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। মডিউলগুলো শিক্ষকতা পেশার বুনিয়াদি গঠনে নতুন শিক্ষক্রমের বিভিন্ন দিকসহ শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগিক এবং মনোপেশিজ বিকাশের প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু, শিক্ষক্রমের উপাদান এবং মূল্যায়ন যথাযথভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোর্সটির সফল বাস্তবায়নের জন্য কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে বলে আমি মনে করি যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
বর্তমান বিটিপিটি কোর্সটিতে পূর্বের কোর্সের চেয়ে বেশি বিষয় যুক্ত করা হলেও সময় কমানো হয়েছে অর্থাৎ ১৬ মাস থেকে কমিয়ে ১০ মাস করা হয়।
থিওরিটিক্যাল বিষয়গুলো সম্পন্ন করতে পূর্বে যেখানে সময় ছিল ১২ মাস বর্তমানে বেশী বিষয় যুক্ত করার পরও সময় মাত্র ৪ মাস।
পূর্বের ডিপিএড ছিল একটি ডিপ্লোমা কোর্স কিন্তু বিটিপিটি সেই মানের কান কোর্স নয়।
বিটিপিটি কোর্সের ক্লাশ রুটিন প্রণয়ন করা হয়েছে সকাল ৬:৩০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ঃ৩০ টা পর্যন্ত,যা একজন সুস্থ্য মস্তিষ্ক মানুষের পক্ষে ১৫-৩০ দিন করা সম্ভব হলেও টানা ছয় মাস সম্ভব নয়।
কোর্সটি যেহেতু সম্পূর্ণ আবাসিক তাই এই ধরনের কোর্স চাকুরীতে যোগদানের পূর্বেই সম্পন্ন করানো উচিত কারণ সংসার জীবনে থেকে এই ধরণের কোর্স সম্ভব নয়।
কোর্সটি অনুশীলনধর্মী হলেও সময় স্বল্পতার কারণে প্রশিক্ষকবৃন্দ কোর্স শেষ করার টার্গেট নিয়েই বেশীর ভাগ সময় পাঠ দিতে দেখা যায়।
বিটিপিটি কার্সটি সম্পূর্ন আবাসিক কিন্তু আবাসিকের যে সকল সুযোগ-সুবিধা (সকালের নাস্তা,দুপুরের খাবার, বিকালের নাস্তা,রাত্রের খাবার ও যাতায়াত ভাতা) থাকা প্রয়োজন তা এই কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বর্তমান দব্যমূল্যের উর্দ্ধগতীর বাজারে প্রশিক্ষণ ভাতা ও কীটস এলাউন্স খুবই অপ্রতুল।
মডিউলের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) অংশটি ল্যাব ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
সার্বিক দিক বিবেচনা করে বলা যায় বর্তমান পেক্ষাপট ও কারিকুলামের জন্য বিটিপিটির মডিউলগুলো যথাপোযুক্ত কিন্তু তার সফল বাস্তবায়নের জন্য সময় বৃদ্ধিকরণসহ উল্লেখিত সীমাবদ্ধতাগুলো নিরূপণ করা জরুরি বলে মনে করি।
লেখক: শিক্ষক