নভেল করোনা ভাইরাসের আঘাতে বিশ্বব্যাপী ধেয়ে আসছে মহামন্দা। বাংলাদেশে এ সংকট থেকে উত্তরণে এরই মধ্যে ৯৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার, যার সিংহভাগই ব্যাংকঋণ। ফলে অর্থনীতিকে টেনে তোলার মূল দায়িত্বটা ব্যাংকের ওপরই পড়ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর ঘোষিত নগদ লভ্যাংশ প্রদান করা হলে সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ক্ষেত্রে তারল্যের ঘাটতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন হাছান আদনান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, কাগজে-কলমে দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯। যদিও মহামন্দার অভিঘাত মোকাবেলার সামর্থ্য ঠিক কয়টি ব্যাংকের আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশের প্রায় সবক’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই মূলধন ঘাটতির চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। এক প্রান্তিকে ঘাটতি থেকে বের হতে পারলেও পরবর্তী প্রান্তিকেই আবার ঢুকে পড়ছে মূলধন ঘাটতির তালিকায়। বেসরকারি খাতের অন্তত এক ডজন ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতিও নাজুক। বিনিয়োগযোগ্য তারল্য নেই অনেক ব্যাংকের হাতেই। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে ব্যর্থ বেশির ভাগ ব্যাংকই সঞ্চিতি সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেও ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের জন্য বড় অঙ্কের নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করছে ব্যাংকগুলো। এরই মধ্যে বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের জন্য নগদ ও স্টক ডিভিডেন্ডের ঘোষণা দিয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোও বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে লভ্যাংশ ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা বের হয়ে বিনিয়োগকারীদের পকেটে ঢুকবে।
বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য সংস্থানে জোর দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। এজন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতের ব্যাংকগুলোর সব ধরনের ডিভিডেন্ড ঘোষণা বন্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আরবিআই চাচ্ছে, ব্যাংকগুলো ডিভিডেন্ড ঘোষণা না করে মুনাফার অর্থ হাতে রাখুক। এতে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে মুনাফার অর্থও বিনিয়োগ করা যাবে। আবার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ায় খেলাপি ঋণের অভিঘাত মোকাবেলা করে ব্যাংকের টিকে থাকার সক্ষমতাও বাড়বে।
আরবিআইয়ের মতো এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর ডিভিডেন্ড ঘোষণার পথ বন্ধ করেছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডও। ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একই পথে হাঁটছে। যদিও ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যাংকগুলো বরাবরই নগদ লভ্যাংশের বিরোধী। এ অবস্থা মোকাবেলায় বাংলাদেশেও ব্যাংকগুলোর ডিভিডেন্ড ঘোষণার পথ বন্ধের দাবি উঠছে। এজন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেন, নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের হয়ে যাবে। অর্থনীতির এ দুর্যোগের সময়ে ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়ে যাওয়া মানেই সর্বনাশ ডেকে আনা। এমনিতেই দেশের ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত আসছে না বললেই চলে। আমানতকারীরা প্রতিনিয়ত ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংককেও রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার পথে হাঁটা উচিত।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আমরা চাচ্ছি কোনো ডিভিডেন্ড না দিতে। কিন্তু দেশের আইন ও সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের বাধ্যবাধকতার কারণে আমাদের ডিভিডেন্ড দিতেই হবে। এ অবস্থায় ত্বরিত ভিত্তিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ সংশোধন করে সরকার। এ অধ্যাদেশে নতুন দুটি উপধারার সৃষ্টি করা হয়। এতে বলা হয়, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবশ্যই লভ্যাংশের ৫০ শতাংশ নগদ দিতে হবে। নগদের চেয়ে যদি স্টক ডিভিডেন্ড বেশি হয়, তাহলে বর্ধিত স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর প্রযোজ্য হবে। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির রিটেইন আর্নিংস যদি মুনাফার ৭০ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে অতিরিক্ত রিটেইন আর্নিংসের ওপরও ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। ব্যাংকগুলোর রিজার্ভসহ সব ধরনের অতিরিক্ত তহবিল রিটেইন আর্নিংসের মধ্যে গণ্য করায় ওই সময়ই সংশোধিত আয়কর অধ্যাদেশ নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ব্যাংকগুলোর আপত্তির মুখেও আইনটি বলবৎ করা হয়। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিধান অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি ডিভিডেন্ড দিতে ব্যর্থ হলে সে কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে গণ্য করা হয়।
সংশোধিত আয়কর আইন ও সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিধিমালার কারণেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে ডিভিডেন্ড দিতে হবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে ব্যাংকগুলো নগদ লভ্যাংশ বা স্টক ডিভিডেন্ড দিতে বাধ্য হচ্ছে, সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ারবাহির্ভূত। এজন্য সরকারকেই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো সন্দেহ ছাড়াই ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ বাড়ানো উচিত।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রশ্ন ওঠাটাই অবান্তর বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে ক্যাশ ডিভিডেন্ড ও বোনাস শেয়ার ইস্যু করে দেশের বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা শত শত কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে। অনেক সময় ব্যাংকের যে মুনাফা দেখানো হয়েছে, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর ডিভিডেন্ড দেয়ার প্রশ্নই আসে না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ৩০ জুন পর্যন্ত কোনো ঋণ খেলাপি না করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে। এ সময়সীমা আরো বাড়তে পারে। ফলে ব্যাংকে টাকা আসার পথ প্রায় বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে মুনাফার অর্থ রিটেইন আর্নিংস হিসেবে ব্যাংকে রাখা দরকার। প্রয়োজনে শেয়ারহোল্ডারদের নামে মুনাফার অর্থ বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর এ অর্থ বণ্টিত হবে, এমন শর্ত দিতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকসহ দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩০। বেসরকারি খাতের ২৯টি ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। দেশের ব্যাংকিং খাতের অর্জিত মুনাফার বড় অংশই এ ব্যাংকগুলোর। অর্থনীতির বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই রিজার্ভ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশের ব্যাংক ডিভিডেন্ড ঘোষণা স্থগিত করেছে। বাংলাদেশেও ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার স্বার্থেই ডিভিডেন্ড ঘোষণা স্থগিত করা দরকার। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের অর্জিত মুনাফা রিজার্ভে যুক্ত হলে ব্যাংকের ভিত মজবুত হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবে, যা দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে। ব্যাংকগুলোর মনোবলও বাড়বে। তবে এজন্য সরকারকে তার আইনগুলো সংশোধন করতে হবে।
আনিস এ খান বলেন, মুনাফার অর্থ রিজার্ভে রাখলে পরিচালকসহ উদ্যোক্তাদের উদ্বেগের কিছু নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা মুনাফার অর্থ ফিরে পাবেন। তবে পুঁজিবাজারের জন্য এর নেতিবাচক প্রভাব আছে। এটি খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করবে বলে আমি মনে করি না। কারণ দেশের পুঁজিবাজার আগে থেকেই বিপর্যস্ত।
তবে ইচ্ছা থাকলেও ডিভিডেন্ড না দেয়ার পরিস্থিতিতে নেই দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, পরিচালকরা সবসময়ই চান, আগের বছরের চেয়ে বেশি ডিভিডেন্ড দেয়া হোক। এ নিয়ে ব্যাংকারদের চাপের মুখেও রাখা হয়। দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকেরই ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়ে গেছে। চার-পাঁচটি ব্যাংক ডিভিডেন্ড ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় ডিভিডেন্ড ঘোষণা স্থগিত করা কঠিন। তবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিলে বাস্তবায়ন করা কঠিন নয়।