বিভক্তি মোচনের ডাক দেয় মিলন দিবস - দৈনিকশিক্ষা

বিভক্তি মোচনের ডাক দেয় মিলন দিবস

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মনে পড়ে, ২৭ নভেম্বর ১৯৯০। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে ঝকঝকে রোদেলা সকাল। এদিন ছিল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও চিকিৎসকদের ২৩ দফা বাস্তবায়ন আন্দোলনের এক পর্যায়ের কর্মসূচি- সারাদেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং পিজি হাসপাতালের বটতলায় সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় চিকিৎসক সমাবেশ। গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর উত্তপ্ত এবং সমাবেশ মিছিল স্লোগানমুখর। আগের দিন থেকে এরশাদের সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনী শহীদ মিনার থেকে চানখাঁরপুল, দোয়েল চত্বর দখল নিয়েছে। আগের রাতে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য বেশ কয়েক দফা তাড়া করে সরিয়ে দিয়েছে। বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি, বোমাবাজি চলছে থেকে থেকে। ডাকসুসহ সব ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন তখন শহীদ জেহাদের লাশ ছুঁয়ে ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা দিয়েছে, 'স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না।'  বুধবার (২৭ নভেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

ডা. মিলন তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক আর আমি প্যাথলজি বিভাগের। ২৬ নভেম্বর ডা. মিলন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ওর বিভাগ হয়ে আমার বিভাগে এলো। দু'জনে মিলে কলেজ ও হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে পরদিন বিএমএর কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জনসংযোগ করলাম। হাসপাতালের ডক্টরস ক্যাফেটারিয়া বন্ধু ডা. রঞ্জুসহ দুপুরের খাবার খেয়ে ওদের বিদায় দিতে গিয়ে দেখলাম, শহীদ মিনার থেকে চানখাঁরপুল এবং দোয়েল চত্বর সশস্ত্র যুবকের দখলে, প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সঙ্গে চলছে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ। ২৭ নভেম্বর সকালে মিলনের অপেক্ষায় থেকে না পেয়ে আমি আর সাইদ পিজি হাসপাতালের দিকে যেই পা বাড়িয়েছি, ঠিক তখনি খবর পেলাম- টিএসসির সামনে একজন ডাক্তার আহত হয়েছে। তাকে ইমার্জেন্সিতে আনা হচ্ছে। আমরা দৌড়ে ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখলাম, ডা. আমজাদ ভাইয়ের নেতৃত্বে মিলনকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকদের আর কোনো সুযোগ না দিয়ে এ দেশের প্রিয় চিকিৎসক নেতা ডা. মিলন হারিয়ে গেলেন সবার মাঝ থেকে।

সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ল উপস্থিত শত শত চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী ও জনতা। মুহূর্তেই বিদ্যুতের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এই মর্মান্তিক সংবাদ- গর্জে ওঠে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ। জনপথের সর্বত্র জনগণের কণ্ঠ- 'মিলন ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না।' মিলনের শেষ শয্যা রচিত হলো তারই প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেদিনের সব আয়োজনের দায়িত্ব বর্তেছিল আমার ওপর। পরিস্থিতি এমনই হতবিহ্বল ছিল, মিলনের মৃত্যু সনদটিও আমাকে লিখতে হয়েছিল। মিলনকে শায়িত করার সঙ্গে সঙ্গে খবর পেলাম, এরশাদ সরকার ইতোমধ্যে কারফিউ জারি করেছে, ঘোষণা করেছে জরুরি আইন, ব্যবহার করল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার শেষ অস্ত্র। ঘোষণার রাতেই কারফিউ ও জরুরি আইন অমান্য করে লাখো মানুষের ঢল নামল ঢাকার রাজপথে ও সারাদেশে।

ডা. শামসুল আলম খান মিলন তৎকালীন বিএমএর যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ। ১৯৮৩ সালে ডাক্তার হওয়ার পর থেকে চিকিৎসক ও পেশাজীবীদের সব আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে নেতৃত্ব প্রদান করেন। প্রতিটি আন্দোলনে তাকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে। এমনকি চাকরিচ্যুত পর্যন্ত হতে হয়েছে। যদিও চিকিৎসক পেশাজীবীদের চাপের মুখে সরকার বারবারই তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে। মিলন তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এ দেশের চিকিৎসক, পেশাজীবী ও রাজনীতিবিদদের হৃদয়ে এক মর্যাদাকর আসন অর্জন করেছিল। '৯০-এর প্রথম দিকে সরকার কর্তৃক একটি স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণার কথা শোনা যায়। অবশেষে সে বছর ২৫ জুলাই জেনারেল এরশাদ জাতীয় সংবাদমাধ্যমে একটি 'জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি' ঘোষণা করেন। বিএমএ ও জনগণ প্রস্তাবিত এই স্বাস্থ্যনীতিকে গণবিরোধী এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণের মাধ্যমে এনজিওনির্ভর করার অপচেষ্টা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় চিকিৎসক মহাসমাবেশ থেকে গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও চিকিৎসকদের প্রাণের ২৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে। তুমুল আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকার ১৪ আগস্ট স্বাস্থ্যনীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল- বিএমএ, পেশাজীবী প্রতিনিধি ও সরকারের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণীত হবে। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল, সরকার একতরফাভাবে বিতর্কিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আবারও একটি কমিটি ঘোষণা করেছে। বিএমএ সেই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ইতোমধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সুসংগঠিত হতে থাকে, তিন জোট ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর মধ্যে ২৭ নভেম্বর মিলন শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে দ্রুত স্বৈরাচারী সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের পতন ঘটে। সেদিন যদি দেশের চিকিৎসক সমাজ গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের আন্দোলন না করত, তাহলে আজকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং মেডিকেল শিক্ষার এক বিশৃঙ্খল নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। এরশাদ সরকারের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রস্তাবিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি চূড়ান্তভাবে বাতিল করে। ডা. মিলনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এ দেশের চিকিৎসক সমাজ তথা বিএমএ, পেশাজীবী সমাজ জনগণের কাছে এক মর্যাদার আসন পেয়েছে।

ইতোমধ্যে দেশের মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চার দফায় দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিসহ চিকিৎসকদের সব দাবি পূরণ করেছেন। নবীন চিকিৎসকদেরও সরকারের সাধ্যমতো নিয়োগ হচ্ছে। বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন বিশ্বের দরবারে সমাদৃত, অনেক ক্ষেত্রেই ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। এখন চিকিৎসকদের গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে, কেমন আছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমালোচনা-পর্যালোচনা রয়েছে। সবই সঠিক তা নয়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জনগণের পূর্ণ সন্তুষ্টি পাওয়া সহজ নয়। কারণ স্বাস্থ্য বাজেটের অপ্রতুলতা, রোগীর অকল্পনীয় চাপ, দুর্বল ব্যবস্থাপনাসহ রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। তারপরও আমাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে সর্বস্তরে।

শহীদ ডা. মিলনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এ দেশের চিকিৎসক সমাজ চিকিৎসাক্ষেত্রে ভেদাভেদ ভুলে দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ্ মেধা, শক্তি, সুযোগ ব্যয় করার অঙ্গীকার করতে পারে।

লেখক: ডা. কামরুল হাসান খান, সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045630931854248