বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথ ভর্তি পরীক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথ ভর্তি পরীক্ষা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ হোস্টেল থেকে সোজা রওনা হই আমার গ্রামের বাড়ি নজিপুর, পত্নীতলা, নওগাঁর পথে। সিদ্ধান্ত ছিল নিজের বাড়ি গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নেব। অনেক বন্ধুর বাধা সত্ত্বেও আমি সিদ্ধান্তে অটল থাকি। বন্ধুদের যুক্তি ছিল, ঢাকায় থেকে কোচিং না করলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে পারব না। এমনকি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়তো ভর্তি হতে পারব না। আমি গ্রামের বাড়ি গিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম এবং সাফল্যজনকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম, যেখান থেকে আমি স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছি। স্নাতকোত্তর, পিএইচডি ও পেডাগজি ডিগ্রি করেছি তামপেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমার জীবনে আমি কোনোদিন কোচিং সেন্টারে কোচিং নিতে যাইনি। এতক্ষণ আমার এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়াটা যতটা না কঠিন ছিল, তার চেয়ে শতগুণ কঠিন ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াটা- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না, এখনও নেই। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে  এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, সেদিনটার কথা কখনও ভুলব না। আমার ভর্তি পরীক্ষা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তার পরের দিন সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিকল্পনা করলাম, নজিপুর থেকে প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেব; তার পর রাতের বাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব। কথামতো কাজ কিন্তু বিধিবাম; কারণ সারারাত বাসযাত্রা শেষে যখন আমি সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছলাম, তখন যারপরনাই ক্লান্তি আর ঘুমেভরা নয়ন। এত ক্লান্তির মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ভালো হয়নি, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হইনি। আর যাতায়াতের ঝামেলার কথা বিবেচনা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ভর্তি পরীক্ষার আবেদনই করিনি। যারা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, তাদের না কত কষ্টই হয়! মনে রাখতে হবে, তরুণদের চেয়ে তরুণীরা কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি বিপদের সম্মুখীন হয়। আমাদের সেই আশির দশকের প্রজন্মের কথা না হয় বাদই দিলাম; কিন্তু এতদিন পরেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেন তরুণ প্রজন্মকে আমাদেরই মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে- এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কেন এত দৌড়াদৌড়ি করতে হবে!

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং এর শিক্ষকরা কি বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে বা পূরণে ব্যর্থ, অনিচ্ছুক না অপ্রস্তুত- এটা বড়ই জানতে ইচ্ছা করে! চারদিকে আইসিটির জয়জয়কার। থমাস ফ্রেইডম্যান তার বই 'সমতল বিশ্বে' লিখেছেন যে, আইসিটি এ বিশ্বের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটাকে সমতল করেছে। এমতাবস্থায় একজন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশে বসে যা করতে পারবেন, ঠিক তেমনি একজন ফিনিশ ফিনল্যান্ডে বসে করতে পারবেন। ডিজিটালাইজেশন ও ইন্টারনেটের বহুল প্রচলন মানুষের মন, চিন্তা-চেতনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্র, কর্মপদ্ধতির মতো সব ক্ষেত্রে বৈপল্গবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই জীবনটা এখন পল্গাগ অ্যান্ড পেল্গর মতো হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি তাদের বিচ্ছিন্ন, ছাত্রবান্ধবহীন, সেকেলে ও অমানবিক নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষার স্থলে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যৌথ ভর্তি পরীক্ষার সূচনা করে, তাহলে তা হবে সময়োপযোগী এবং ছাত্রবান্ধব এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য দৌড়াদৌড়ি থেকে পরিত্রাণ পাবে আমাদের তরুণ-তরুণীরা।

সমাজের যে কোনো প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন, তা যদি ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্য উৎপাদন করতে না পারে এবং সেবা দিতে অক্ষম হয়, তাহলে সে প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। অতি সম্প্রতি আমরা দেখেছি, এশিয়ান ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থান তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কতটা যে লেজেগোবরে অবস্থা। এই লেজেগোবরে অবস্থা থেকে উত্তরণের অনেক পদক্ষেপের মধ্যে একটা পদক্ষেপ হয়তো হতে পারে যৌথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রচলন। যৌথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রচলনে কীভাবে এগোতে পারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তা এখানে আলোচনা করা হলো ক্রমানুসারে-১. প্রথমে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ ভর্তি পরীক্ষা প্রচলনে একটি নির্দেশনা আসতে পারে; ২. বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ ভর্তি পরীক্ষা শুরুর একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে; ৩. উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ ভর্তি পরীক্ষা প্রচলনে একটা স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও দেশ-বিদেশের পরামর্শক সমন্বয়ে; ৪. স্টিয়ারিং কমিটি কয়েক ভাগে যৌথ ভর্তি পরীক্ষা প্রচলনের সুপারিশ করতে পারে, যেমন- মেডিকেলের যৌথ ভর্তি পরীক্ষার মতো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যৌথ ভর্তি পরীক্ষা, বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলোর জন্য একটি যৌথ ভর্তি পরীক্ষা, মানবিক বিভাগের বিষয়গুলোর জন্য একটি যৌথ ভর্তি পরীক্ষা, বাণিজ্যিক বিভাগের বিষয়গুলোর জন্য একটি যৌথ ভর্তি পরীক্ষা এবং যারা বিভাগ পরিবর্তন করতে চাইবে, তাদের জন্য একটি যৌথ ভর্তি পরীক্ষা; ৫. যৌথ ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রতিটা বিভাগের, যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান ও মানবিকের একটা সর্বজনীন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা যেতে পারে। তবে এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ নিজ শর্তের সমন্বয় বিধানের সুযোগ থাকতে হবে; ৬. স্টিয়ারিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা ভর্তি বোর্ডের সৃষ্টি করা যেতে পারে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে ভর্তি পরীক্ষার আবেদনপত্র গ্রহণ, সর্বজনীন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণ করতে পারে; ৭. পরিশেষে আবেদনপত্রে আবেদনকারীর পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ও বিষয়ের ক্রমানুসারে এবং ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় বণ্টন করা যেতে পারে। এভাবে চিরতরে অবসান হতে পারে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার কষ্টকর এবং অমানবিক প্রথার।

এটা সত্য যে- নিজেকে, অপরকে, কোনো প্রতিষ্ঠানকে বা কোনো প্রচলিত প্রথাকে পরিবর্তন করা বেশ কঠিন কাজ। মজার ব্যাপার হলো, পরিবর্তন কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়। তাই আমরা সবাই মিলে সর্বাত্মক চেষ্টা করলে যৌথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রচলন অসম্ভব কিছু হবে না; কিন্তু হবে মাত্র সময়ের ব্যাপার। এটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভালো। আমরা এগিয়ে যাব, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

ড. কাজী ছাইদুল হালিম : ফিনল্যান্ড প্রবাসী, শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট।

নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064501762390137