বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ

অধ্যাপক মো: জহির উদ্দিন আজম |

বাংলাদেশের শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা ও প্রাপ্য অধিকার প্রশ্নে বিদ্যমান বৈষম্যের নিরিখে আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে উক্ত দিবসটি উদযাপন করা অত্যাবশ্যক। আজ যখন আমরা বিশ্ব শিক্ষা দিবস পালন করছি, তখন এদেশে হাজার হাজার শিক্ষক চাকরিচ্যুত কিংবা রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় নিমজ্জিত। আইনের আশ্রয় নিয়েও দুর্নীতিবাজ এবং রাজনৈতিক পরিচালনা পরিষদের হাত  থেকে নিরাপদ থাকতে পারছেন না। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব  শিক্ষক দিবস পালন বিশেষ তাৎপর্যের দাবি রাখে। অথচ জাতিসংঘ সনদে সর্বশ্রেণির পেশার মানুষের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিশ্ব  শিক্ষকদের অধিকার ও আত্মমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তক্রমে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব  শিক্ষক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।

বাংলাদেশ সরকার এবং শিক্ষক সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগে শিক্ষক ও শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃত প্রফেসর এম শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম এই দিবসটি পালিত হয়। কিন্তুু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রতি বছর অন্যান্য দেশে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হলেও ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের পর আমাদের সরকারগুলো অজ্ঞাত কারণে বিশ্ব  শিক্ষক দিবস পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নীরব থেকে শিক্ষকদের প্রতি এক প্রকার উদাসীনতাই প্রদর্শন করে আসছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্যে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন শিরোনামে তথা প্রতিপাদ্যে যেমন ‘শিক্ষক: পূনর্জাগরণের অগ্রদূত’,  ‘শিক্ষক : সুন্দর বিশ্ব বিনির্মাণের প্রবক্তা’, ‘মানসম্মত শিক্ষার জন্য মেধাবী শিক্ষক’, ‘শিক্ষার জন্য আমরা, শিক্ষকদের পাশে আমরা’, প্রভৃতি প্রতিপাদ্যে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে `The right to education means the right to a qualified teacher’ উল্লিখিত প্রতিপাদ্যগুলো পর্যালোচনা করলে শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা তথা পেশাগত অধিকারের স্বীকৃতির প্রতি অত্যধিক গুরত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং মানসম্মত শিক্ষার জন্য মেধাবী শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তার প্রতি বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ শাসন অবসানের পরও যে ঔপনিবেশিক আমলের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চলছিল, অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মর্যাদার ব্যবধান ও বৈষম্য তা পাকিস্তান আমলেও অব্যাহত ছিল। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোন বৈষম্য থাকবে না, এটাই ছিল সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু না, এই বৈষম্য এখনো দূরীভূত হয়নি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মরহুম শিক্ষকবন্ধু প্রফেসর এম শরীফুল ইসলাম, প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান, অধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ পাঠান, অধ্যক্ষ মো: ইসহাক হোসেন প্রমুখ শিক্ষক নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকশিস) ও অধ্যক্ষ পরিষদের (বিপিসি) দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের জন্য জাতীয় বেতন স্কেল, চাকরিবিধি ও অবসর সুবিধাভাতা প্রদান চালু এবং ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রারম্ভিক বেতনের শতভাগ অর্জন হয়।

কিন্তু অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থেকে এখনো শিক্ষকগণ বঞ্চিত। এখনো পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং টাইম স্কেল ও প্রমোশন প্রভৃতির ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষদের মধ্যে চরম বৈষম্য। অর্থাৎ এখনো শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও পেশাগত মর্যাদার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়নি। এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির অশুভ হস্তক্ষেপে প্রতিদিন চাকরিচ্যুত হচ্ছেন কিংবা বিভিন্ন হয়রানির শিকার হচ্ছেন এ দেশের বেসরকারি শিক্ষকগণ। আইনের আশ্রয় চেয়েও বছরের পর বছর কোন প্রতিকার পাচ্ছে না এসব শিক্ষক। বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যা ও হয়রানির প্রতিকারে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের কোন কার্যকর ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরেরও কোন কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ বা গভর্ণিং বডি ও কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে একদিকে বেসরকারি শিক্ষকগণ কথায় কথায় চাকরিচ্যুতির ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে কাক্সিক্ষত শিক্ষা ও পাঠদানে মনোযোগী হতে পারছেন না। অন্যদিকে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বিধায় শিক্ষায় মেধাশূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশের অভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনে চলছে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। এ অবস্থায় মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মেধাবী শিক্ষক এই প্রতিপাদ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। এখন সময়ের দাবি হচ্ছে, মেধাবীরা এই পেশায় যাতে নিরুৎসাহিত না হয়, সে জন্য শিক্ষদের আত্মমর্যাদার নিশ্চয়তা বিধান যেমন জরুরি, তেমনি শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সকল বৈষম্যের অবসান।

সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান প্রভৃতি ক্ষমতা সরকারি কর্মকমিশন, শিক্ষা অধিদপ্তর-বোর্ডও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে ন্যস্ত করা এবং এসব প্রতিষ্ঠানে আরো কার্যকর ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনবল কাঠামো বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক  বৈধভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত সকল শিক্ষকের এমপিওভুক্তিকরণ অত্যাবশ্যক। 

পর্যায়ক্রমে সরকারি ও বেসরকারি সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ ও সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে এর কোন বিকল্প নেই। আইএলও এবং ইউনেস্কোর সনদ অনুযায়ী ‘সমযোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি সমান পেশায় নিয়োজিত থাকলে তারা সমান মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হবেন’। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতসহ প্রত্যেক দেশে এই সনদের পরিপূর্ণ প্রতিফলন হয়েছে। অর্থাৎ এসব দেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের পেশাগত সমান মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ বারবার আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দেশের শিক্ষক সমাজকে অতি কষ্টে বর্তমান অবস্থায় আসতে হয়েছে, যা অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও অবমাননাকর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সম্প্র্রতি ‘জনবল কাঠামো- ২০১৮’ নামে জারি করা আইনটি এই দেশের শিক্ষক সমাজের জন্য চরম অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক। অনতিবিলম্বে এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণকে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য কোনো প্রকার শর্তারোপ বন্ধ করে জনবল কাঠামো ২০১৮ সংশোধন ও সংস্কার করতে হবে। এই নিয়ম সকল পেশায় বিদ্যমান রয়েছে বিধায় এটি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পেশাগত অধিকার। এমপিওভুূক্ত ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা বোর্ডগুলোতে প্রেষণে নিয়োগ করতে হবে। তাহলেই বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০১৮-এর মূল প্রতিপাদ্যের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

আমাদের দেশে বিদ্যমান পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষাক্রম ও ত্রুটিপূণ মূল্যায়ন পদ্ধতি বিশেষ করে সৃজনশীল পদ্ধতির নামে জগড়াখিচুড়ি মার্কা শিক্ষা পদ্ধতি ও অতি মূল্যায়ন সিস্টেম বাতিল করে জীবনমুখী, উৎপাদনশীল, কারিগরি প্রযুক্তি ও পেশাগতভাবে উপযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতি এবং নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষানীতি চালু করা অত্যাবশ্যক। মোদ্দা কথা, সামগ্রিকভাবে শিক্ষা পদ্ধতির ত্রুটি এবং লক্ষ্যহীন শিক্ষানীতির কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা কর্মোপযোগী ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হয়ে উঠছে না। যার কারণে শিক্ষিত বেকার ও অনৈতিক মনোভাবাপন্ন যুব সমাজের ভারে আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং যুব সমাজ ক্রমশ অনৈতিক কার্যক্রমে, বিশেষ করে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অতএব এই বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে মূল প্রতিপাদ্য ধারণ করে আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রম ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা যথাযথভাবে কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে আমাদের আগামী প্রজম্ম সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও মূল্যবোধ সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠতে পারে এবং কর্ম দক্ষতা নিয়ে জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারে। তাহলেই এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্যের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে এবং দিবসটি পালন সার্থক হবে।


 

লেখক: যুগ্ম  সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকশিস)।

সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ - dainik shiksha শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039310455322266