বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস: নবতর কেলেঙ্কারি - দৈনিকশিক্ষা

বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস: নবতর কেলেঙ্কারি

নুরুল ইসলাম নাহিদ |

শেষ পর্যন্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) এবং মেধার ভিত্তিতে বিসিএস ক্যাডার বাছাই করার পরীক্ষাও সংকীর্ণ দলীয়করণের লালসা ও কেলেঙ্কারির শিকার হলো। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২৪তম বিসিএস পরীক্ষার পূর্বেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। ঐদিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে, কোচিং সেন্টারে, ফটোস্ট্যাটের দোকানে হাতে লেখা প্রশ্নপত্র ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়ার খবর জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিস্তৃত বিবরণসহ প্রকাশিত হয়েছে। পিএসসি'র ইতিহাসে এই প্রথম এ ধরনের ঘটনায় সবাই বিস্মিত হয়েছেন। 

একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে বিকেল সাড়ে ৩টায় পরীক্ষা শুরুর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ইমামুল হক শামীম দুপুর দেড়টায় হাতে লেখা প্রশ্নপত্র নিয়ে রমনা থানায় জিডি করতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। শামীম পরে একটি জাতীয় দৈনিককে জানান, দুপুর দেড়টার দিকে তিনি হাতে লেখা ৭৫টি প্রশ্নোত্তর নিয়ে জিডি করতে রমনা থানায় গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। শামীমের কাছ থেকে নেয়া প্রশ্নোত্তর কপিটি সংগ্রহ করে দেখা যায়, অনুষ্ঠিত বিসিএস পরীক্ষার ৭৫টি প্রশ্নের সঙ্গে ৭২টির হুবহু মিল রয়েছে।'

অন্য একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পরীক্ষা অনুষ্ঠানের দিন সকালেও প্রশ্নপত্র বিক্রি করা হয়। পরীক্ষা শুরুর আধঘণ্টা আগে বিকেল তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামীম নামে এক ছাত্র রমনা থানায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রসহ জিডি করতে যান, তবে রমনা থানার ওসি এই জিডি গ্রহণ করেননি। প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্পর্কে আরও জানা যায়, প্রথমে ছাত্রদলের কয়েকজন ক্যাডারের হাতে প্রশ্ন পৌঁছে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এই ক্যাডাররা প্রশ্নপত্র বিক্রি শুরু করলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ছাত্রদল ক্যাডারদের মাধ্যমেই এই প্রশ্নপত্র ছাত্রদলের সাবেক নেতার নিয়ন্ত্রণাধীন ফার্মগেটের ঐ কোচিং সেন্টারে পৌঁছানো হয়। এছাড়া নীলক্ষেত ও ফার্মগেট এলাকায় কয়েকটি ফটোকপির দোকান থেকেও প্রশ্নপত্র বিক্রি করা হয়। ৮২টি প্রশ্ন সংবলিত এই প্রশ্নপত্রের ৮০টি পরীক্ষায় হুবহু কমন পড়ে বলেও জানা যায়।' 

‘প্রশ্নপত্র ফাঁস : এক ছাত্র সংগঠনের কিছু কর্মী ও কোচিং সেন্টার জড়িত' এই শিরোনামে অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রথমে একটি নির্দিষ্ট ছাত্রগোষ্ঠির হাতে এই প্রশ্নপত্র আসে। উদ্দেশ্য ছিল তাদের পরীক্ষায় উৎরে নেয়া। এই গোষ্ঠির কেউ কেউ প্রশ্নপত্র নিয়ে ব্যবসা করতে যাওয়ায় বিপত্তি বাধে। ওই নির্দিষ্ট ছাত্রগোষ্ঠির বাইরেরও অনেকে প্রশ্নপত্র কিনতে আসেন। ফলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বহু শাখা প্রশাখা বিস্তৃত ঢাকার একটি কোচিং সেন্টারের একজন পরিচালক জড়িত বলে খবর পাওয়া গেছে।' 

বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যখন সকল জাতীয় দৈনিকে এ ধরনের বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে, সমাজের সকল মহলে তোলপাড় চলছে, পরীক্ষাথীরা সর্বত্র বিক্ষোভ করছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল হচ্ছে, ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে, তখন পিএসসি'র চেয়ারম্যান সম্পূর্ণ উদাসীন। 
ইউএনবি'র খবরে জানা যায়, পিএসসি'র চেয়ারম্যান অধ্যাপক জেড এন তাহমিদা বেগম অভিযোগটিকে অমূলক ও গুজব বলে নাচক করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'কথাটি ডাহা মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। আমি মনে করি, এটি পিএসসি'র বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র' । অবশেষে সরকারি কর্মকমিশন বিসিএস পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। এ সম্পর্কে পিএসপি'র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পরীক্ষা অনুষ্ঠান বিষয়ে জনমনে সৃষ্ট সন্দেহ ও বিতর্ক নিরসনকল্পে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া সম্পর্কে কোনরূপ প্রমাণ না পাওয়া সত্ত্বেও এই পরীক্ষা বাতিল করা হল।

 পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় : 
 ১. বিসিএস পরীক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে এখানে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সবচেয়ে মেধাবী ও উপযুক্ত প্রার্থীকে নির্বাচন করার লক্ষ্যে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন নজির নেই । এই প্রথম এ ধরনের ঘটনা ঘটল। এই ঘটনা আমাদের দেশের জন্য সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে।

 ২. প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে দেশে তোলপাড় সৃষ্টি এবং গণমাধ্যমে উপযুক্ত তথ্য- প্রমাণসহ এ খবর প্রকাশিত হলেও পিএসসি'র চেয়ারম্যান প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই অভিযোগ কিছুতেই মানতে চাননি।             

৩. একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও জনমতের চাপে বাধ্য হয়ে পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে একথা চেয়ারম্যান ও পিএসসি বলেও দিয়েছেন। 

৪. পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ‘একটি নির্দিষ্ট ছাত্রগোষ্ঠি'র হাতে এই প্রশ্নপত্র আসে। তাদের সাথে সম্পর্কিত একটি কোচিং সেন্টারও জড়িত। অধিক মুনাফার লোভে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। 

৫. একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ও যুক্তি রয়েছে যে, প্রশাসনকে দলীয়করণের প্রক্রিয়ারই একটি ধারাবাহিকতা ও পরিণাম হিসেবে প্রশ্নপত্রে ‘একটি নির্দিষ্ট ছাত্রগোষ্ঠি ও কোচিং সেন্টারের' হাতে চলে যায়। দলীয় প্রার্থীদের সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই তা করা হয়েছে বলে যে কোন মানুষ বিশ্বাস করেন।

৬. পিএসসি'র চেয়ারম্যান এত প্রমাণের পরও এমনকি পরীক্ষা বাতিল করার পরও স্বীকার করতে রাজি নন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এর কারণ কী হতে পারে? স্বীকার করলে এবং সঠিক ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে যদি আসল রহস্য বের হয়ে পড়ে তাই বিষয়টি অস্বীকার করে চলেছেন। 

৭. যে কোন বিষয়ে থানায় জিডি করা অত্যন্ত প্রাথমিক ও ন্যূনতম একটি রেকর্ড মাত্র। রমনা থানার ওসি তা করতে রাজি হলেন না কেন? কেউ যদি এটাকে রহস্যময় মনে করে তা হলে কি অন্যায় হবে? 

৮. প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পিএসসি'র চেয়ারম্যান বলেছেন, তিনি মনে করেন পিএসসি'র বিরুদ্ধে এটি 'ষড়যন্ত্র'। বর্তমান সরকারের কৌশল অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে 'ষড়যন্ত্র' ও 'ভাবমূর্তি' বিনষ্টের কথা বলে আসল কারণ ও অপরাধীকে আড়াল করার কৌশল এখানেও লক্ষণীয়। 

৯. পিএসসি'র মতো সাংবিধানিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে বিএনপি- জামায়াত জোট সরকার কর্তৃক দলীয়করণের পরিণামে আমাদের রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? 

১০. কোনো সরকার ও তার দলের প্রতি আনুগত্য নয়; পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মান, নৈতিকতা ও নিষ্ঠা এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া অবশ্যই জরুরি। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অবশ্যই এর বিহিত করতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে আসল কারণ ও দায়ী। ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও শাস্তি প্রদান করতে হবে। এ ধরনের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। পিএসসি ও তার চেয়ারম্যান কোনভাবেই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না । 

১৪-০৩-২০০৩
 (লেখকের ‘শিক্ষানীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে সংকলিত)  

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ - dainik shiksha ১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053558349609375