বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের কাজ ভুলেছেন - দৈনিকশিক্ষা

বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের কাজ ভুলেছেন

ইমরান ইমন |

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে করেছিলো বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাও। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করতে থাকে এবং সে তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫ মার্চ রাতেই হত্যা করা হয়।

পাকিস্তানি হানাদাররা ২৫ মার্চ রাতে যখন এদেশের নিরস্ত্র মানুষদের ওপর ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল, তখন তাদের প্রথম শিকার হয়েছিলেন আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তপর্বে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় যখন আসন্ন, তখনও তারা আরো এক দফা বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতে ওঠেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে পাকিস্তানি এই মেজর জেনারেলের স্বহস্তে লিখিত ডায়েরি পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধে ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন এতো বছর পরও তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা সম্ভব না হলেও সরকারিভাবে বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জনের একটি তালিকাও অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। মূলত ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। যার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয় ১৪ ডিসেম্বরে। পরিকল্পনার মূল অংশে দেশের শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, লেখক, গবেষকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানি হানাদাররা এবং তাদের এদেশীয় দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা হতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরও অনেক স্থানে থাকা টর্চারসেলে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জেলাওয়ারি শহীদ শিক্ষাবিদ ও আইনজীবীদের একটি আনুমানিক তালিকা প্রকাশিত হয়। সেই তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ৯৬৮ জন শিক্ষাবিদ, ২১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নাম ছিলো। এ ছাড়া বাংলাপিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী ও ১৬ জন সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলীর নাম ছিলো। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বরেণ্য বুদ্ধিজীবী পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান।

প্রশ্ন উঠতে পারে, পাকিস্তানি হানাদাররা সাধারণ জনগণের মধ্যে কেনো বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলো? শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, লেখক, গবেষকসহ এসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত মানুষকে কেনো তারা হত্যার সিদ্ধান্ত করেছিলো? এবং চূড়ান্ত পরাজয়ের মুহূর্তে কেনো তারা নিজেদের সব জিঘাংসা চরিতার্থ করতে আবারও বেছে নিয়েছিল সেই বুদ্ধিজীবীসমাজকেই? কারণ, তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলো, একটা জাতি পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে ওঠে তার বুদ্ধিজীবীদের দেখানো পথ ধরে। বুদ্ধিজীবী ছাড়া একটি জাতি সমৃদ্ধির পথে এগুতে পারে না। বুদ্ধিজীবী শূন্য মানে একটি দেশ ও জাতির অর্জন শূন্য। পাকিস্তানি হানাদারদের সেই স্বপ্ন অনেকটাই কার্যকর হয়েছে। জাতির সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশকে বিশ্ব থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী পিছিয়ে দিয়েছে।

রাষ্ট্রের মধ্যে কোথাও যখন অনিয়ম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন তার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ অনুভূত হয় বুদ্ধিজীবীর মনে। বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠ তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের এমন দায়িত্বশীলতা লক্ষ্য করা যায় না। এখনকার বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন দলের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে ভুলেই গিয়েছেন যে, বুদ্ধিজীবীর স্বরুপ কী, বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব কী!

আমরা যদি অতীত ইতিহাসের দিকে তাকাই তখন দেখতে পাবো, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি কতোটা দায়িত্বশীল ও সোচ্চার ছিলেন। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এখন আবার বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে সামিল হতে হবে। বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজের মাঝে উপলব্ধির সঞ্চার ঘটাতে হবে। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা, সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলা বুদ্ধিজীবীর নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এখন সোনার হরিণের মতো। তবুও অনেক দেশপ্রেমিক মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও সে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

একটা রাষ্ট্রের চিন্তা ও মনন গড়ে ওঠার পেছনে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অনস্বীকার্য। চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এখন সব ক্ষেত্রে অসুন্দর ও অনিয়মে ছেয়ে গেছে। দেশে এখন ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট’ প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। যে কারণে স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পরও আমাদের পূর্ণাঙ্গ মুক্তি মেলেনি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতির সূর্যসন্তানের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তাদের হারানোর ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে স্বদেশ। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রজন্মের মাঝে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা’ জেগে উঠুক-এটাই।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর - dainik shiksha এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074529647827148