বুয়েটের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা প্রসঙ্গে - দৈনিকশিক্ষা

বুয়েটের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা প্রসঙ্গে

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশে বুয়েটের একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে। এর শিক্ষাক্রম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কিছু কেন্দ্রীভূত বিষয় নিয়ে বুয়েটের শিক্ষাক্রম গঠিত। এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পদ্ধতি অভিনব এবং প্রভাবমুক্ত। এর শিক্ষাক্রম আধুনিক প্রযুক্তি ও পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার সমকক্ষ। বুয়েটের একজন অ্যালামনাস হিসেবে এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে এই তুলনা করার যোগ্যতা রাখি বলে বিশ্বাস। সোমবার (৮ এপ্রিল) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আমাদের ছাত্রজীবনে বুয়েটের সংস্কৃতি ছিল মুক্তচিন্তাভিত্তিক এবং শিক্ষার পরিবেশ ছিল উন্মুক্ত ও অযাচিত প্রভাবমুক্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বুয়েটের সার্বিক শিক্ষার পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে জেনেছি। এ পরিস্থিতির ভয়াবহতা, এমনকি নিরপরাধ ছাত্রের প্রাণনাশের ইতিহাসও পাঠকের জানা।

সর্বশেষ, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে বুয়েট। কেউ প্রশ্ন তুলছেন ছাত্র রাজনীতির ভালো-মন্দ নিয়ে; কেউ দুষছেন সরকারকে, কেউবা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে। কেউ আবার বুয়েট একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিনাু প্রশ্ন তুলেছেন তা নিয়েও। কেউ কেউ বুয়েটের শিক্ষক ও ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্বে অবহেলার অপবাদ দিচ্ছেন। বুয়েট পরিস্থিতি যখন নাজুক, ছাত্রদের মানসিকতা বিক্ষুব্ধ, শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রে ন্যুব্জ, নিরুপায়, তখন প্রতিষ্ঠানটিকে অহেতুক সমালোচনার জবাব দেওয়া অ্যালামনাসের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। 

প্রথম প্রসঙ্গ ছাত্র রাজনীতি। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজ পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রেখে এসেছে। এর দার্শনিক ভিত্তিও রয়েছে। ১৭ শতকের সুইস দার্শনিক রুশো তাঁর ‘এমিল’ বা ‘শিক্ষা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে বলেছেন, শিক্ষার উচিত সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, নৈতিক সততা এবং নাগরিক দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা। উনিশ শতকের ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল সামাজিক বিচারে তারুণ্যের বিশেষ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ‘দ্য ফাংশনস অব এ টিচার’ গ্রন্থে বলেছেন, শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের সামাজিক সমস্যাগুলোর সঙ্গে জড়িত হতে উৎসাহিত করা এবং একটি উন্নত বিশ্বের জন্য কাজ করতে তাদের অনুপ্রাণিত করা। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সামাজিক বিচার, শান্তির আবাহন, যুদ্ধবিরোধী সুর এমনকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে ডাক এসেছে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি জার্মানিতে ‘হোয়াইট রোজ মুভমেন্ট’ গড়ে তোলে, যা হিটলারের অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করেছে। ষাটের দশকে ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরোধী সুর উঠেছে ‘মোব’ নামে ছাত্রদের তৈরি সংগঠন থেকে, যারা ১৯৬৭ সালে ১৫ এপ্রিল নিউইয়র্ক শহরে চার লাখ লোকের সমাগম করেছিল। সত্তরের দশকে পারস্যের ইসলামিক বিপ্লব ও পরবর্তী সময়ে ‘দি অফিস অব স্ট্রেংদেনিং ইউনিটি’ নামে ছাত্র সংগঠন সমাজ পরিবর্তনে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। 

বিশ্বব্যাপী ছাত্রদের এই সোচ্চার কণ্ঠস্বর আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্ব ও ভূমিকার সমান্তরাল। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা মনন গড়ার কারখানা, সেখানে সমাজ, রাষ্ট্র ও অধিকার নিয়ে কথা হবে; বিতর্ক হবে; এটাই তো স্বাভাবিক। বুয়েটের ছাত্ররাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না কখনও। সব সামাজিক আন্দোলনেই বুয়েট সরব হয়েছে। তবে যেখানে সাধারণ ছাত্রদের আপত্তি তা হলো, তাদের সুগঠিত শক্তিকে ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় রাজনীতির ফায়দা তোলা। 

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা। বুয়েটকে বিশ্ববিদ্যালয় বলাটা যৌক্তিক কিনাু এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কতিপয় বুদ্ধিজীবী। বুয়েট প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাই এ প্রতিষ্ঠানের ফোকাস সীমিত। সে কারণে বুয়েটকে নাকি বিশ্ববিদ্যালয় বলা চলবে না। 

বুয়েটের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এমএইটি, ক্যালটেক, ভার্জিনিয়া টেক, জর্জিয়া টেক ও আইআইটির নামকরণ এবং তাদের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হাস্যকর। উল্লিখিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। তবে তাদের নামে ইনস্টিটিউট বা পলিটেকনিক এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেটি বুঝতে হবে তা হলো, যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামো এবং যে দেশে তা অবস্থিত, সে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের বিন্যাসে তার অবস্থান প্রতিষ্ঠানটির বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উপযোগিতার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। যেমনু এমএইটি, ক্যালটেক বা ভার্জিনিয়া টেকের প্রশাসনিক কাঠামোতে থাকা বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, প্রেসিডেন্ট, প্রভোস্ট, ফ্যাকাল্টি সিনেট বা ডিন যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কিছু প্রাইভেট আর কিছু পাবলিক হলেও এদের প্রশাসন স্বায়ত্তশাসিত। বাংলাদেশের যে কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রশাসক একজন উপাচার্য, যিনি চ্যান্সেলরের অধীনে কাজ করেন। তাই প্রশাসনিকভাবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অর্থে প্রধান হলেন চ্যান্সেলর। তাদের শিক্ষাক্রম ও ডিগ্রির অনুমোদন দিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এটি যেমন বুয়েটের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। বুয়েটকে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে কলেজ বা ইনস্টিটিউট বললে এর শিক্ষাক্রম, ডিগ্রির বৈধতা বা প্রশাসনিক কাঠামোর কোনো রদবদল হবে না। তাই শুধু বুয়েটকে ছোট করার উদ্দেশ্য ছাড়া এ বিতর্কের আর কোনো অন্তর্নিহিত কারণ আছে বলে বোধ হয় না। 

তৃতীয় প্রসঙ্গ, বুয়েটের সামাজিক দায়িত্ব। বুয়েটিয়ানদের ছাত্র রাজনীতিবিরোধী ডাককে কেউ কেউ সমাজবিচ্ছিন্নতার লেবেল লাগাতে চান। অথচ তারা ভুলে যান একাত্তরে শহীদ বুয়েট ছাত্রদের কথা। তাঁরা উপেক্ষা করেন ২০১৩ সালের প্রজন্ম চত্বরে বুয়েটের সম্পৃক্ততার কথা; ২০১৮ সালে সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনে বুয়েট ছাত্রদের নেতৃত্বের কথা। যে কোনো ছাত্রের তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং নিরাপত্তা দাবি করার অধিকার রয়েছে। বুয়েটের ছাত্রছাত্রী এটুকুই চাইছে। দেশের জন্য গর্ব ছিনিয়ে আনতে, দেশকে গবেষণালব্ধ আবিষ্কার দিতে, দেশের দুঃসময়ে, জরুরি অবস্থায় পাশে দাঁড়াতে বুয়েটিয়ানরা কখনও পিছপা হয়নি; হবেও না।

বুয়েটের একজন গর্বিত অ্যালামনাস হিসেবেু যে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে নির্বিঘ্নে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, অনায়াসে ম্যাগাজিনে সামাজিক সমস্যা নিয়ে লিখেছে; আমি ছাত্র-শিক্ষকদের এক্সেলেন্সের ওপর ভরসা রাখি। বুয়েটে ছাত্রছাত্রীদের একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস, সুস্থ শিক্ষার পরিবেশ, মুক্তচিন্তা প্রকাশের আবহাওয়ার দাবি যৌক্তিক এবং প্ৰাসঙ্গিক। এই গর্বের প্রতিষ্ঠানের সম্মানকে বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার দায়িত্বে অবহেলা কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। 

লেখক: নাভিদ সালেহ, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক

১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ - dainik shiksha ১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060021877288818