জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বুয়েটভিত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর আইনগত ভিত্তি নেই। বুয়েট চত্বরে তারা বেআইনিভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে এসেছে। কিন্তু সে জন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কখনো নেয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। এমনকি বুয়েটের নিজস্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী এসব ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম যে নিষিদ্ধ, সেটাও বুয়েট প্রশাসন-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে খুব স্পষ্ট ধারণা নেই। আইন থাকতেও তা অব্যাহতভাবে লঙ্ঘন করতে দেয়া হয়েছে। যাঁদের কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা, তাঁরা কেউ এগিয়ে আসেননি। বুয়েটের হলগুলোতে চলেছে র্যাগিং, নির্যাতন, হত্যাসহ নানা নৃশংসতা। আবরার ফাহাদের মতো মেধাবী শিক্ষার্থী খুন হলেন বিপথগামী আরেক দল সতীর্থ মেধাবীর হাতে। সোমবার (১৪ অক্টোবর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বুয়েটের মূল আইন হলো ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের দ্য ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি অর্ডিন্যান্স। এই আইনের অধীনে প্রণীত হয়েছিল একটি বোর্ড। পুরো নাম ‘অর্ডিন্যান্স রিলেটিং টু দ্য বোর্ড অব রেসিডেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন’। অননুমোদিত ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব এই বোর্ডের। কিন্তু তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিল। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জুলাই বুয়েটের একাডেমিক কাউন্সিল ওই অধ্যাদেশকে সর্বশেষ সংশোধন ও অনুমোদন দিয়েছিল বলে জানা যায়।
এই অধ্যাদেশের ১৬ ধারা বলেছে, ‘ডিরেক্টর অব স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ারের (ডিএসডব্লিউ) লিখিত অনুমোদন ছাড়া কোনো ক্লাব বা সোসাইটি বা ছাত্রসংগঠন (বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, ডিপার্টমেন্ট বা হল অ্যাসোসিয়েশন ব্যতিরেকে) গঠন করা যাবে না। ডিএসডব্লিউর পূর্ব অনুমোদন ছাড়া বুয়েট চত্বরে ছাত্রদের কর্তৃক কোনো সভা, পার্টি বা বিনোদনের আয়োজন করা যাবে না কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলাকালীন ছাত্ররা কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারবে না।’
তাহলে কোন আইনবলে ছাত্ররাজনীতি চলছিল এবং বুয়েট আইন কেন কার্যকর করা হয়নি, জানতে চাইলে বুয়েটের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, ‘ওই আইনের আলোকে এটা করতে পারলেই ভালো হতো। তবে এ বিষয়ে আমরা অবশ্যই ভাবব।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে আইনানুগ সংগঠনগুলোর বেশির ভাগই ক্লাব। এর সংখ্যা ২৯। এর বাইরে যত সংগঠনই থাকুক, তা বৈধ নয়। তিনি নিশ্চিত করেন যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে যত সংগঠন ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তার একটিও ওই ২৯টি সংগঠনের মধ্যে নেই।
সাধারণভাবে বুয়েটের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হিসেবে ডিএসডব্লিউ পদটি সব থেকে বেশি আলোচিত। তবে শৃঙ্খলাসংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ড। বোর্ডই সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করতে পারে। শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কাউকে যে কোনো মেয়াদে বরখাস্ত বা আজীবনের জন্য বহিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে বোর্ড। উপাচার্যের নেতৃত্বাধীন এই বোর্ড ৯ সদস্যের। বোর্ডের সদস্যসচিব হলেন পরিচালক (ডিএসডব্লিউ)।
আবাসিক হলের শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি প্রভোস্টরা নির্ধারণ করেন। কিন্তু আইনে সার্বিকভাবে আটটি আবাসিক হলসহ বুয়েটের সর্বত্র শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব নির্দিষ্টভাবে এই বোর্ডকে দেয়া হয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপাচার্যের নেতৃত্বাধীন বোর্ড প্রায় বসেই না। আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে বোর্ডের আনুষ্ঠানিক সভা ডাকা হয়নি। বর্তমান ডিএসডব্লিউ গত ৩০ জুন দায়িত্ব নিয়েছে। গত ১০৩ দিনের মধ্যে একটি সভা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে এই বোর্ডের ৯ সদস্যের মধ্যে ১ জন আছেন বুয়েটের বাইরে। তিনি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রওনক মাহমুদ।
বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন স্থপতি ও সিভিল প্রকৌশল বিভাগের দুই ডিন। পদার্থ ও ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের দুই বিভাগীয় প্রধান এবং সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল ইসলাম হলের দুই প্রভোস্ট। বোর্ড অধ্যাদেশের ২ উপ-দফা বলেছে, বোর্ডের ৯ সদস্যের যে কোনো ৫ জনকে নিয়েই বোর্ডের কোরাম হবে।
বোর্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা চাইলে উপাচার্য এবং ডিএসডব্লিউকে অগ্রাহ্য করেও আজীবনের জন্য বহিষ্কারের শাস্তি নির্ধারণ করতে পারেন। আবরারের বাবা ১৯ অভিযুক্তকে সাময়িক বহিষ্কারের যৌক্তিকতা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন।
শৃঙ্খলা বিষয়ে প্রভোস্টের দেয়া দণ্ডের (হল থেকে অনধিক ১ বছর বরখাস্ত) বিরুদ্ধে ডিএসডব্লিউ, উপাচার্যের ঘোষিত কোনো দণ্ডের বিরুদ্ধে বোর্ড অব রেসিডেন্স এবং বোর্ড অব রেসিডেন্সের দেয়া শাস্তির বিরুদ্ধে একাডেমিক কাউন্সিলে আপিল করা যাবে।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের মূল আইন অনুযায়ী, শিক্ষকেরা রাজনৈতিক সংগঠনে নাম লেখাতে পারবেন না। কারণ, দণ্ডবিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী বুয়েটের শিক্ষকেরা পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে গণ্য হন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম মাসুদ বলেন, বুয়েটের ওই বিধানের আশু বাস্তবায়ন আশা করেন তিনি।
সনি হত্যার পরে
২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুন বুয়েটে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হন কেমিকৌশল বিভাগের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। এরপর ২০ জুলাই একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ওই আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে বলা হয়, ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ বা কর্মসূচি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
২০০২ খ্রিষ্টাব্দে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা শেষে ঘোষিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে বুয়েট শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে বা তার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না। এই শৃঙ্খলাবিধি তাঁদের যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং তা অমান্য করলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সনি হত্যার ১৭ বছর পরে গতকাল রোববার রাতে ওই আইন ও সিদ্ধান্ত অকার্যকর থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেছেন একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ। তিনি বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ডিএসডব্লিউর দায়িত্বেও ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত রাতে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো প্রশ্রয় দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তারা তাদের ছাত্র শাখা কমিটি ঘোষণা করেছে। আর তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে শিক্ষকদের একটি ছোট গ্রুপ। এসব কারণে ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বুয়েট আইন তো মানতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদিও প্রশ্ন তুলেছেন যে সনি হত্যার পরে বুয়েট অ্যালামনাই কোথায় ছিল। কিন্তু বুয়েট অ্যালামনাই প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের পরে। সনি হত্যার পরের সিদ্ধান্তগুলো এবং অধ্যাদেশ অকার্যকর থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চপর্যায়ের সদিচ্ছা দরকার। বুয়েটকে বাঁচাতে হলে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। দলগুলো যদিও দাবি করে ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের অঙ্গ নয়, কিন্তু কার্যত তারা দলগুলোরই অংশ। ৯০ শতাংশ ছাত্রই ভয়ে দলগুলোর চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে।