বেকারত্বের বোঝা আর কত ভারী হবে? - Dainikshiksha

বেকারত্বের বোঝা আর কত ভারী হবে?

মেহেদী হাছান |

আমাদের বিদ্যালয়ের ‘সামাজিক বিজ্ঞান’-এর শিক্ষক ক্লাসে প্রায়ই একটি ছোট ছড়া বলতেন। ‘দেশ ছোট, মানুষ বাড়ছে দেশে, এমনি করে বাড়লে মানুষ কি হবে রে শেষে!’ বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। মোট জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম একটি দেশ। জনসংখ্যা অবশ্যই একটি দেশের সম্পদ। কিন্তু অতিমাত্রায় কোনোকিছুই কল্যাণকর নয়। বাংলাদেশের বেলায় জনসম্পদের প্রাচুর্য সুবিধার বদলে অসুবিধাই তৈরি করছে বেশি। ছোট ক্ষেত্রফলে এত বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র কিছুটা বিপাকেই আছে। অপ্রতুল সম্পদে সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্র। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। জনসংখ্যার অধিকতার কারণে আরো নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ তন্মধ্যে যে সমস্যাটি দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে তা হলো ‘বেকার সমস্যা’।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিধান অনুযায়ী বেকার বলতে তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা ‘চার সপ্তাহ কাজ খুঁজেছে অথচ পায়নি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ পেতে পারে বা বিদ্যমান মজুরিতে কাজ শুরু করবে এমন কর্মক্ষম লোক’। সহজ ভাষায় এভাবে বলা যায় যে, একটি দেশের শ্রমশক্তির সেই মানুষগুলো বেকার যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজের সন্ধান করা সত্ত্বেও কোনো কাজ পায়নি। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপে বেকার বলতে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের বয়স ১৫ বা তার বেশি এবং যারা সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করে বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কাজ করেনি। যদিও কাজের জন্য প্রস্তুত এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পেয়েও করেননি এমন বেকার বাংলাদেশে একজনও পাওয়া যাবে কি-না তা আমার সন্দেহ।

গত ১৭ই অক্টোবর ৩৬তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্মকমিশন। এ ফলাফলে ২ হাজার ৩২৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। আর ৩ হাজার ৩০৮ জন পরবর্তীকালে নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন। সর্বমোট ৫ হাজার ৬৩১ জন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। যা মোট প্রার্থীর ২.৫৪ শতাংশ। ৩৬তম বিসিএস-এর প্রার্থী সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৩২৬ জন। উত্তীর্ণ না হওয়া প্রায় দুই লক্ষাধিক তরুণ-তরুণী আজ বেকার। হতাশায় ডুবে থাকবেন কিছুদিন। হতাশা নেমে আসবে তাদের পরিবারেও। ধৈর্যধারণ করে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আবারো চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। আবার কেউবা নিজের ও পরিবারের জীবিকার্জনের অসীম তাগিদে বেছে নিবে অন্যায় পথ। বেকারত্বের কারণে কেউ যদি বিপথগামী হয় এর দায় কে নেবে?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশে ১৫ বছরের অধিক বয়সী কর্মক্ষম শ্রমশক্তি প্রায় ৬ কোটি ৭ লাখ। তন্মধ্যে ৫ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় কর্মরত আছে। পরিবারের মধ্যে কাজ করে কিন্তু কোনো মজুরি পান না এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। যার প্রায় সম্পূর্ণ ভাগই নারী। আরো ১ কোটি ৬ লাখ দিনমজুর, যাদের কাজের নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিধান অনুযায়ী তারাও বেকার। তাহলে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২ কোটি ৪৪ লাখ। বেসরকারি তথ্যমতে এ সংখ্যা আরো বেশি। এ সংখ্যা থেমে নেই। প্রতিবছর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ২৩ লাখ কর্মক্ষম শিক্ষিত মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে কাজের সুযোগ পাচ্ছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ নাম লিখাচ্ছেন বেকারের তালিকায়। যে হারে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে সে হারে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। মোট শ্রমশক্তির একটি বিশাল অংশ কর্মহীন রেখে একটি রাষ্ট্র উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। যার ফল ইতোমধ্যে আমরা ভোগ করছি। এ অবস্থার আশু সমাধান প্রয়োজন। সমাধানের পূর্বে ‘বেকার সমস্যা’ বৃদ্ধির মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

প্রথমত, বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করার পিছনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে নতুন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি না হওয়া। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। মানুষ তার কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের নিরাপত্তার কথাই বেশি চিন্তা করেন। এমতাবস্থায় সরকারের করণীয় হবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত অর্থের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা। এতে করে দেশে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে দক্ষ মানবসম্পদ ও উদ্যোক্তার অভাব। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সার্টিফিকেটধারী করছে কিন্তু দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের কর্মকমিশনের অবকাঠামো এখনো এমন এক পর্যায়ে আছে যেখানে একজন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চাকরি পাচ্ছেন একজন কূটনীতিক হিসেবে। অন্যদিকে ইসলামিক স্টাডিজে ডিগ্রিধারী একজন নিযুক্ত হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সহকারী পরিচালক’ হিসাবে। এ হিজিবিজি অবস্থা কখনোই কাম্য নয়। এ অদ্ভুত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে এবং কারিগরি শিক্ষার উপর বেশি নজর দিতে হবে। প্রাথমিক স্তরের পর থেকে পাঠ্যক্রমে কারিগরি শিক্ষা ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত করতে হবে। এতে করে দেশ পাবে দক্ষ মানবসম্পদ। বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষ মানুষেরা চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে যান না। কারণ, তাদের মধ্যে খুব সহজে আত্মনির্ভরশীল উদ্যোক্তা হওয়ার কারিগরি দক্ষতা থাকে। অনুকূল পরিবেশ পেলে তাদের মধ্যে থেকে বের হয়ে আসতে পারে এমন সব সফল উদ্যোক্তা যারা ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে রাখবেন অনবদ্য ভূমিকা।

বেকারত্বের বোঝা আর কত ভারী হবে? এ বোঝা আর কতদিন বয়ে বেড়াবে রাষ্ট্র? সময় এসেছে ‘বেকার সমস্যা’ সমাধানের। অতিশীঘ্র এ সমস্যার সমাধান না করলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যা অকল্পনীয়। সরকারের উচিত কালবিলম্ব না করে এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত, কার্যকরী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

লেখক :শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064640045166016