বেকার তৈরির এই শিক্ষায় কী লাভ? - দৈনিকশিক্ষা

বেকার তৈরির এই শিক্ষায় কী লাভ?

বিমল সরকার |

এ বছর মার্চে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে মোট সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৮২ লাখ অর্থাৎ প্রায় এক-চতুর্থাংশই প্রকৃত বেকার। কী সাংঘাতিক কথা! ২০১৮ সালের শুরুর দিককার কথা। একদিন ফেসবুক আইডিতে প্রবেশ করতে না করতেই দৃষ্টি পড়ে এক বন্ধুর দেয়া একটি পোস্টের প্রতি। শিক্ষাবিষয়ক পোস্টটিতে ওই বন্ধু আমাদের দেশের একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বেকার তৈরির কারখানা’ বলে অভিহিত করেছেন।

এরপর একটি সপ্তাহ যেতে না যেতেই নবনিযুক্ত একজন মন্ত্রীও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। মন্ত্রী মহোদয় কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রচলিত আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ‘বেকার তৈরির কারখানা’ বলে অভিহিত করেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এহেন মন্তব্য সচেতন সবার জন্য অবশ্যই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ভাবনা-দুর্ভাবনার বিষয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আকস্মিক বা রাতারাতি গড়ে উঠেনি। মূলত ইংরেজদের উদ্যোগে এবং ওদেরই হাতে উনিশ শতকে গোড়াপত্তন হয়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে আধুনিক এ শিক্ষা ব্যবস্থা।

ইংরেজরা ১৯৪৭ সালে রাজ্যপাট গুটিয়ে উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেয়। পাকিস্তানি শাসন চলেছে আরও চব্বিশ বছর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর গত হতে চলেছে আরও ৪৭টি বছর। নানা চড়াই-উতরাই এবং আশা-নিরাশা সবকিছু মিলে বলা যায়, আমাদের চলমান শিক্ষাপরিক্রমার বয়স এখন আনুমানিক দুইশ’ বছর। 

বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক আর শিক্ষা ব্যবস্থাই হোক, আজ তা ‘বেকার তৈরির কারখানা’- কী সাংঘাতিক কথা! একটি স্বাধীন জাতির কাছে এর চেয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং ভাবনা-দুর্ভাবনার বিষয় আর কী হতে পারে।

রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) আজ থেকে দেড়শ’ বছর আগে এখানকার ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করার বিষয়টিকে মহাভারতে বর্ণিত পাণ্ডবদের স্বর্গারোহণের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বিখ্যাত ‘সেকাল আর একাল’ গ্রন্থে তিনি আমাদের দেশের ইংরেজি শিক্ষার প্রণালিকে ‘মানুষ মারার কল’ বলেও অভিহিত করেছেন। 

মহাজন রাজনারায়ণের ভাষায়, ‘পাণ্ডবরা পাঁচ ভাই ও দ্রৌপদী স্বর্গের পথে যাইতে যাইতে প্রথমে দ্রৌপদী, পরে সহদেব, পরে নকুল, পরে অর্জুন, পরে ভিম একজনের পর একজন পড়িয়া গেলেন। সর্বশেষে কেবল একা যুধিষ্ঠির স্বর্গারোহণ করিলেন। তেমনি যে সব ছাত্র প্রথমত এন্ট্রেন্স কোর্স পড়ে, তাহার মধ্যে কতকগুলো এন্ট্রেন্স পরীক্ষা না দিতে দিতে পড়িয়া যায়। ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষা না দিতে দিতে আর কতকগুলো পড়িয়া যায়। বিএ পরীক্ষা না দিতে দিতে আর কতকগুলো পড়িয়া যায়। এমএ উপাধি প্রাপ্তি অর্থাৎ স্বর্গারোহণ অতি অল্প লোকেরই ভাগ্যে ঘটে। এক হিসাবে বর্তমান ইংরেজি শিক্ষার প্রণালিকে মানুষ মারার কল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।’

দীর্ঘদিন পর চিন্তাবিদ রাজনারায়ণ বসুর মন্তব্যেরই যেন প্রতিধ্বনি শুনতে পাই নবনিযুক্ত আমাদের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের কণ্ঠে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতায় মোস্তাফা জব্বার আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে ‘বেকার তৈরির কারখানা’ বলে অভিহিত করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা থেকে মন্ত্রিত্ব পাওয়া মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে না পারলে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের জটিলতায় পড়তে হবে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জন্য বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে প্রকৃত অর্থে সামনের দিনগুলোয় আমাদের সন্তানদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব না (জনকণ্ঠ : পৃষ্ঠা ২০; ৬/০১/২০১৮)।’

মাঝে দেড়শ’ বছরের ব্যবধান। ১৮৭৪ সালে ‘সেকাল আর একাল’ যখন গ্রন্থস্থ হয়, কলকাতাসহ কেবল অবিভক্ত বাংলায় (পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম প্রভৃতি অঞ্চল) নয়, গোটা উপমহাদেশে তখন তিনটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। আর গোটা কয়েক কলেজ। এ ছিল ব্রিটিশ-ভারতে উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণের মোটামুটি ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও, অত্যন্ত সীমিত গণ্ডির মাঝেও বসুমশাই তরুণদের সে সময়কার এমএ পাস করাটাকে মহাভারতে বর্ণিত কাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আর শিক্ষাদানের পদ্ধতিটিকেও মানুষ মারার কল হিসেবে চিহ্নিত করতে একটুও দ্বিধা করেননি।

আর দীর্ঘদিন পর- ২০১৮ সাল। সময় বদলেছে। পদ্মা মেঘনা যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে নদীগুলোর গতিপথও। বর্তমানে আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডে রয়েছে ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে প্রায় ১০০টি। বছর বছর বেড়ে চলেছে সরকারি এবং বেসরকারি মিলে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটি। ‘জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা’ প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়ন বোধ করি আর খুব একটা দেরি নেই। সারা দেশে তিন হাজারের মতো কলেজ।

অনার্স পড়ার ব্যবস্থা আছে আটশ’র মতো এবং মাস্টার্স দুইশ’র বেশি কলেজে। আর পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাস-ফেল? এসএসসি, এইচএসসি, ডিগ্রি (পাস ও অনার্স) এবং মাস্টার্স- বলা যায় কোনোভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারলেই পাস। পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলের মতো পরীক্ষায় একবার কিংবা একাধিকবার ফেল করে লেখাপড়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে, এমন কথা এখন আর তেমন একটা শোনা যায় না। গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, এমনকি বলা যায় বাড়িতে বাড়িতে এখন শিক্ষিত লোক। ভালো রেজাল্টের ছড়াছড়ি। সর্বত্র কেবল এ প্লাস আর এ প্লাস। ঘরে ঘরে এবং প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে কেবলই জিপিএ-৫ পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ- এ বছর কয়জন, আগেরবার কয়জন ছিল। জিপিএ পাঁচ এবার কমে গেল কেন আরও কত রকমের হিসাব ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মানুষ মারার কল’ আর ‘বেকার তৈরির কারখানা’ যাই বলি না কেন, এই শিক্ষিত ‘জনশক্তি’টির প্রকৃত অবস্থার খোঁজখবর আমরা ক’জন রাখি?অবশ্য লেখাপড়া যেমন-তেমন, পরীক্ষা পাস করাটা এখন আর খুব কষ্টসাধ্য কোনো বিষয় নয়। তবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি হচ্ছে কর্মসংস্থান নিয়ে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আগে যেমন বলা হতো ‘মানুষ মারার কল’ ঠিক এমনই এখন বলা হয় ‘বেকার তৈরির কারখানা।’ এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সঠিক পথ খোঁজাটা আজ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। 

বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ; কিশোরগঞ্জ

সূত্র : দৈনিক যুগান্তর

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038249492645264