দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরে দুই সেমিস্টার চালু করার প্রস্তাব করেছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সঙ্গে নীবিড়ভাবে যোগাযোগ তৈরির জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পূর্ণকালীন প্রোগ্রামগুলোয় ন্যূনতম চারটি কোর্স রেখে বছরে দুটি সেমিস্টার রাখতে চাচ্ছে। নতুন এ পদ্ধতিতে অনুমোদিত সংখ্যার চাইতে কোনোভাবেই বেশি শিক্ষার্থী করা যাবে না।
ইউজিসির সদ্য প্রকাশিত ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারের কাছে এ প্রস্তাব দেয়। ইউজিসির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গত ২৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন। এতে মোট ২৯টি সুপারিশ করা হয়েছে। এ বছর সুপারিশমালার শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিন সেমিস্টারের পরিবর্তে দুই সেমিস্টার চালু করা।
কেন দুই সেমিস্টার চালু করা হচ্ছে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে মাত্র একবার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সারা বছর ধরে শিক্ষার্থীকে ভালোভাবে বিষয়গুলো আত্মস্থ ও রপ্ত করার সময় দেয়া হয়। উন্নত দেশগুলোতে বছরে স্প্রিং ও ফল এ দুটি সেমিস্টার। আর আমাদের দেশে বছরে তিনটি- স্প্রিং, ফল ও উইন্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। প্রতি চার মাসে একটি সেমিস্টার। একটি সেমিস্টারের পাঠ ভালোভাবে রপ্ত করার আগেই আরেকটি চলে আসে। এভাবে জব মার্কেটে শিক্ষার্থীরা গিয়ে পিছিয়ে পড়েন। আবার প্রতি সেমিস্টারে প্রতিবার শিক্ষার্থীকে নতুন করে ভর্তি হতে হয় বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে।
তিনি আরও বলেন, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে ১৬০ থেকে ১৮০ ক্রেডিট পর্যন্ত পড়ানো হয়। বিবিএতে পড়ানো হয় ১৬৪ ক্রেডিট। প্রশ্ন হলো আসলেই এত ক্রেডিট পড়ানো সম্ভব কি না? এ দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকঠাক পালন করতে পারছে কি না, এ বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। এজন্যই ইউজিসি একটি স্ট্যান্ডার্ড গাইড লাইন অনুসরণ করতে দুই সেমিস্টার চালু করার সুপারিশ করেছি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বছরে দুই সেমিস্টার পদ্ধতিতে 'ডুয়েল সেমিস্টার' ও তিন সেমিস্টার পদ্ধতিকে 'প্রাইম সেমিস্টার' বলা হয়। মূলত বাণিজ্যিক কারণেই প্রাইম সেমিস্টার পদ্ধতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ দেশে চালু করেছে। তারা বলেন, কেবল বাজার ও বাণিজ্যমুখী বিষয়গুলোকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশেষ করে যে বিষয়গুলো চাকরির বাজারে গুরুত্বপূর্ণ বা চাহিদাসম্পন্ন, সেগুলোই পড়ানো হয়। বাংলা, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি এমনকি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিতের মতো বিষয়ও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বহীন। এসব কারণেও সেমিস্টার কমাতে চায় ইউজিসি। কারণ বাণিজ্যনির্ভর বিষয়গুলোর পাঠে কোনো 'নৈতিক' ও 'আদর্শিক' বিষয় থাকে না।
এ ব্যাপারে বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তিনি বরাবরই সেমিস্টার পদ্ধতির বিপক্ষে। আগের ইয়ার সিস্টেমই ভালো ছিল। একজন শিক্ষার্থী চার বা ছয় মাসে মাত্র দুটি কোর্স পড়বে, স্বাভাবিক কারণে তারা প্রচুর অবসর সময় পাবে। এতে কেউ কেউ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদকসহ নানা অপতৎপরতায় জড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই পুরো পদ্ধতিরই খোলনলচে পাল্টে ফেলা জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে তিন সেমিস্টার পদ্ধতির লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েও অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। কমিশন দুই সেমিস্টার পদ্ধতির নির্দেশনা দিয়ে ইতোমধ্যে দুই দফা সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। আর নতুন যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে, সেগুলোতে শুরু থেকেই দুই সেমিস্টার পদ্ধতি চালুর নির্দেশ দিয়েছে।
তবে ইউজিসি একই সঙ্গে পূর্ণকালীন প্রোগ্রামে ন্যূনতম চারটি কোর্স সংবলিত বছরে দুই সেমিস্টার পদ্ধতি চালুর কথা বললেও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চারটি কোর্স পড়ানোর জন্য ইউজিসির প্রস্তাবটি ভুল। ছয় মাস একটি সেমিস্টার হলে প্রতি সেমিস্টারে কমপক্ষে ছয়টি কোর্স পড়াতে হবে। নাহলে চার বছরে গ্র্যাজুয়েশন (অনার্স) শেষ হবে না। পাঁচ বছর লেগে যাবে।
একাধিক সূত্র জানায়, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যারা তাদের কোর্স-কারিকুলাম ইউজিসি থেকে অনুমোদন নিচ্ছে, তাদের সবাইকে বছরে দুই সেমিস্টারের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। ইউজিসির পরিচালক ফখরুল ইসলাম বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ১৫ থেকে ১৮ বছর একই কোর্স পড়িয়ে যাচ্ছে। এটা কেমন কথা? যুগ বদলাচ্ছে। নিত্যনতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ তারা বছরের পর বছর একই বিষয় পড়িয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় তিন বছর পর পর নতুন কোর্স-কারিকুলাম অনুমোদন না করিয়ে নিলে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়। বাংলাদেশের আইনে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
জানা গেছে, ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাল চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, সিন্ডিকেট, অর্থ কমিটি ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান করা হয় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলরের নিয়োগ করা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর নিয়ম অনুযায়ী তাদের নিরীক্ষিত বার্ষিক হিসাব ইউজিসিতে দাখিল করে না। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনেকাংশে লঙ্ঘন করা হয়, যা কাম্য নয়। বিষয়গুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে আনতে হবে।
ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশা :দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চালচিত্র তুলে ধরে ইউজিসি সরকারকে বলেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিশদভাবে উল্লেখ নেই ট্রাস্টি বোর্ড, একাডেমিক কাউন্সিল, উপাচার্য এবং সিনেটের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের বিষয়ও। এ কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
ফলে মেধাবী শিক্ষকরা প্রায়ই অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যান। এ ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক বিষয়গুলো স্বচ্ছভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে উপস্থাপন করছে না। আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনাগ্রহ রয়েছে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীক্ষিত অডিট রিপোর্টে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এর যথাযথ অনুসরণ করা হয় না।
চাকরির অনিশ্চয়তা : ইউজিসি সরকারকে বলেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ সার্ভিস স্ট্যাটিউট প্রণীত না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে চাকরি-সংক্রান্ত বিষয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, যা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে অন্তরায়। ইউজিসির প্রস্তাবে আরও বলা হয়, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য পূর্ণাঙ্গ সার্ভিস স্ট্যাটিউট প্রণয়ন করতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী সিন্ডিকেট, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, একাডেমিক কাউন্সিল ইত্যাদি বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহণের জন্য সিটিং অ্যালাউন্স, বিদেশ ভ্রমণ, আর্থিক বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টপূর্বক একটি স্ট্যাটিউট প্রণয়ণপূর্বক ইউজিসির মাধ্যমে চ্যান্সেলরের কাছ থেকে অনুমোদন গ্রহণের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া যায়।
আর্থিক স্বচ্ছতা নেই : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিক নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য তাগিদ দিয়ে ইউজিসি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত বহির্নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের (সিএ ফার্ম) মধ্য থেকে সরকার মনোনীত একটি ফার্মকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নিরীক্ষা করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পছন্দের তালিকায় থাকা তিনটি অডিট ফার্ম থেকে সরকার একটি অডিট ফার্মকে মনোনয়ন দেয়। এর ফলে আর্থিক স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করা যায় না। সেজন্য ইউজিসির পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী স্বনামধন্য কোনো ফার্ম নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অডিট করানো যেতে পারে।