বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক যে, আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বাবলম্বী পরিবারের লাখ লাখ সন্তানের পদচারণায় মুখরিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। দুই. উচ্চশিক্ষা প্রসারে দেশে অনুমোদিত ও প্রতিষ্ঠিত অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার চর্চা নেই বললেই চলে। পাঠদানের মাধ্যম বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি। বিষয়টি দোষের হবে না, যদি মাতৃভাষায় মৌলিক জ্ঞানচর্চার পর্যাপ্ত সুযোগও থাকে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার লেশমাত্র নেই। কর্মসংস্থানমুখী বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে এক ধরনের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার কারণে মাতৃভাষা উপেক্ষিত হয়েছে। যদিও 'বাংলাদেশ স্টাডিজ' নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়, যার শিক্ষার মাধ্যমও ইংরেজি। শিকড়চ্যুত জাতি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না বলে বাঙালি জীবনের বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতায় মাতৃভাষা বাংলা চর্চার বিকল্প নেই। তিন. অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তান দেশের স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বিষয়টি ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে ইঙ্গিত করে। তবে দুঃখের বিষয়, সেসব মুষ্টিমেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অদম্য মেধাবীর পড়াশোনা দুঃস্বপ্ন মাত্র। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯২ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা স্পষ্ট থাকলেও পারিবারিক সদস্যের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে পরিচালনা করায় সেবামূলক-অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বাণিজ্যিক দিকটি স্পষ্টতর হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকা বাধ্যতামূলক করা হলেও ক্যাম্পাসবিহীন অলিগলি কিংবা মোড়ে মোড়ে ভাড়া করা ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে খুব বেশি উপকারে আসবে বলে মনে হয় না। সরকারের পক্ষে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ পরিপূর্ণভাবে সম্ভব নয়, যদি সবাই সার্বিকভাবে সহযোগিতা না করে। ইউজিসি একাধিকবার আপত্তি জানিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও আদালতে রিট দায়ের করে স্থগিতাদেশ নিয়ে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। কারণ নিরাপদ ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং লগ্নিকৃত পুঁজির চেয়ে বহুগুণে মুনাফা অর্জন করা তাদের পক্ষে অতি সহজ। চার. সার্বিক কল্যাণে 'একাডেমিক-প্রশাসনিক কার্যক্রম' পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা দরকার যেন কোনো পক্ষই কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোভাবেই যেন লাখ লাখ বেকার তৈরির অনুমোদিত কারখানায় পরিণত না হয়। 'সনদসর্বস্ব উচ্চশিক্ষা' কোনো শিক্ষা হতে পারে কি? 'কোচিং সেন্টারধর্মী উচ্চশিক্ষা' ব্যবস্থা থেকে বের হতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রি করতে পারেন তার একটি বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাঁচ. দেশের লাখ লাখ পরিবার ও তাদের সন্তানদের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আশীর্বাদের মতো। তাই স্থায়ী ক্যাম্পাস, মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষ আছে কিনা, তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। মানসম্মত অভিন্ন সিলেবাস প্রণয়ন ও অনুসরণে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। 'যত সেমিস্টার, তত টাকা'- এই ধারণা ও পরিচর্যার অবসান দরকার। দুঃখজনক বিষয় হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ সেমিস্টারে স্নাতক সম্পন্ন হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে ১২ সেমিস্টারে সম্পন্ন করতে হয়।
শিক্ষার্থী কোনোভাবেই যেন অন্যায়ের কাছে জিম্মি না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হওয়া দরকার। ছয়. কিছু বিষয় নতুন করে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন : ৮ সেমিস্টারে স্নাতক সম্পন্নের ব্যবস্থা। দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা (২ শতাংশ), অদম্য হতদরিদ্র মেধাবী (২ শতাংশ), প্রতিবন্ধীদের (১ শতাংশ) জন্য আবাসন ও বৃত্তির ব্যবস্থাসহ বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ। শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানী এমন মানদণ্ডের অনাত্মীয় সদস্যের (সরকার মনোনীতসহ) অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যাবলি পর্যবেক্ষণ, পরিচালনা ও অনুমোদনের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো 'সিন্ডিকেট' কিংবা 'রিজেন্ট বোর্ডের' ব্যবস্থা করা দরকার, যেখানে সরকার ও ট্রাস্টি বোর্ড মনোনীত সদস্যরা থাকবেন, 'খণ্ডকালীন শিক্ষক' নির্ভরতা অবশ্যই কমাতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষককে 'খণ্ডকালীন শিক্ষক' হিসেবে নিয়োগ দিলে শিক্ষার মান বৃদ্ধিসহ শিক্ষার্থীদের উপকারে হয়তো আসে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন তা ছুটির দিনে, নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য ঘণ্টার বাইরে এবং সংখ্যায় তা যেন পূর্ণকালীন শিক্ষক সংখ্যার চেয়ে বেশি না হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কেউ যেন বৈষম্যের দৃষ্টিতে না দেখতে পারে, রাষ্ট্রকে সেই দায়ভার নিতে হবে, শিক্ষার্থীদের 'ক্লাস নোট' প্রদান না করে 'মৌলিক বই' পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের সচেষ্ট হতে হবে।
শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ
সূত্র: সমকাল