উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে ভর্তির মৌসুম। সাধারণত বছরের শেষ দিকেই সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়।
আমাদের দেশে কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে সব স্তরের শিক্ষার্থীকে ভর্তি প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। আর এই ভর্তি মৌসুমে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রীতিমতো বাণিজ্যে নেমে পড়ে। আবার অনেক সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দালালচক্রের ফাঁদে পা দিয়েও অনেক টাকা-পয়সা খোয়ায়। উল্লেখ্য, অতি সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর কিছু অসাধু চক্র মেধাতালিকায় অনেক পেছনে থাকা শিক্ষার্থীদের এসএমএস বার্তার মাধ্যমে ভর্তি করে দেওয়ার প্রলোভন কিংবা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিম টাকা দাবি করে। কোনো শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক এই দালালচক্রের ফাঁদে পা দিয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে সতর্কতা ও সচেতনতামূলক প্রচার অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এমন ঘটনার বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির জন্য নানা ধরনের বাণিজ্যের ফাঁদে পা দিচ্ছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। ফন্দিবাজ নানা দল ও ব্যক্তি ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি করার একটা সুযোগও খোঁজে। কখনো সফল হয়, কখনো হয় না। ভর্তি করানোর নামে বিভিন্ন পরিচয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগও পত্রিকার পাতায় আসে।
অবশ্য বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ভর্তিপ্রক্রিয়ায় যেসব বাণিজ্যের খবর শোনা যায়, তা রীতিমতো আমাদের অবাক করে তোলে। ভর্তির ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে রাজধানীর ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে এ বছরের শুরুর দিকে চিঠি পাঠিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আবার গত আগস্ট মাসে শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুদক ১০টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে অস্বচ্ছতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে মন্তব্য করে দুদক উল্লেখ করেছিল, এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উচ্চশিক্ষা জাতির জন্য আত্মঘাতী হবে। এমনকি দুদক মনে করে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যবস্থা না নিলে দুর্নীতি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
আমাদের দেশে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের অবস্থা এমন স্তরে পৌঁছেছে যে দুদক ও উচ্চ আদালতকে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধে দুদক ও উচ্চ আদালত বিশেষ ভূমিকা রাখলেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো ‘ডোন্ট কেয়ার’ স্টাইল অনুসরণ করে চলছে। এমনকি দুদক ও উচ্চ আদালতের দেওয়া নানা হুঁশিয়ারি কিংবা চিঠি উপেক্ষা করেও সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দালালচক্রের পাশাপাশি প্রকাশ্যে তথাকথিত বৈধ উপায়ে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে অহরহই বাণিজ্যের ফাঁদে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদা, অথচ এটি নিশ্চিত করতে এখন কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের লেনদেন হচ্ছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর। ঢাকায় তুলনামূলক ভালো বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের শুধু মেধাই এখন যথেষ্ট নয়, এ জন্য অভিভাবকদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তির নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ভর্তির জন্য লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি কালের কণ্ঠে ‘প্রাইভেট মেডিক্যালে হাতির খরচ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের চিত্র ফুটে উঠেছে।
আমরা সব সময়ই শিক্ষার সংস্কার নিয়ে কথা বলি। শিক্ষাকে একটি নিষ্কণ্টক জায়গায় পৌঁছাতে অনেকেরই আন্তরিকতা লক্ষ করা যায়। তবু কেন যেন কোনো এক অজানা কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। কালের কণ্ঠ’র ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ‘ভর্তির যোগ্যতার মাপকাঠি কিংবা আসন বা শিক্ষার্থীর সংখ্যার হিসাব ছাপিয়েও বড় হয়ে উঠেছে টাকার বিষয়টি। জানা গেছে, এখনো ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া না হলেও কলেজগুলোতে ভেতরে ভেতরে চলছে বড় অঙ্কের ভর্তি ফি নেওয়ার তোড়জোড়। বাইরে তত্পরতা চলছে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি দেওয়ার জন্য। আর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেও টাকার অভাবে ভর্তি হতে না পারার আশঙ্কায় অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারেই দেখা দিয়েছে উদ্বেগ, ক্ষোভ, হতাশা। ’ বর্তমানে প্রাইভেট মেডিক্যালে একজন শিক্ষার্থীর ভর্তি থেকে শুরু করে শেষ বর্ষ পাস করে বের হওয়া পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়। এত টাকা খরচ করে একজন শিক্ষার্থী ডাক্তার হয়ে রোগীর সেবা দানে কেমন ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে আমরা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারি। শিক্ষা যদি টাকার বিনিময়ে অর্জিত হয়, তাহলে সেই শিক্ষা জনগণের কল্যাণে কতটুকু লাগতে পারে?
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধের কথা জাতিসংঘও বারবার উল্লেখ করেছে। আমরা নিজেরাও এ বিষয়ে অনেকবার লিখেছি এবং বলেছি। কিন্তু এর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাবলিক শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় অনেক। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা সংকট পরিলক্ষিত হলেও এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ কোনো মনোযোগ দেখতে পাচ্ছি না। এককথায় বলা যায়, শিক্ষা বাণিজ্যের পূর্ণ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। শিক্ষার এই বাণিজ্যিকীকরণের কারণেই সমাজের একটি বিরাট অংশের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আদালতের উদ্যোগ এবং দুদকের সাহসী পদক্ষেপ সত্ত্বেও সারা দেশে শিক্ষাকে বাণিজ্যের কোটায় নিয়ে যাওয়ার যে অশুভ প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা এখনই বন্ধ করা সময়ের দাবি। আর তা না হলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ কোনোভাবেই শুভ হবে না। ক্রমেই ভেঙে পড়বে শিক্ষার প্রতিটি স্তর।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: কালের কণ্ঠ