১৯৫২ সালে বাঙালির যে ভাষাবোধ জেগে উঠেছিল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। জীবন হয়ে উঠেছিল গৌণ, ভাষাই মুখ্য। ভাষার দাবিতে অনড় বাঙালি জাতি সে সময় জীবনের বিনিময়ে ভাষা রক্ষা করেছিল, ভাষার গৌরব বাড়িয়েছিল। তখন বাংলা ভাষার প্রতি দায়বোধের এক পরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। জীবনের বিনিময়ে পাওয়া ভাষার প্রতি বর্তমানে দায়বোধ যেন ফিকে হয়ে আসছে। ভিনদেশি ভাষার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র এবং বিকৃত ভাষাকাঠামোর কাছে কখনো কখনো যেন আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা অসহায় হয়ে উঠছে। শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাংলা ভাষার শব্দসংখ্যা, শব্দের অর্থ ব্যঞ্জনার বৈচিত্র্য, শ্রুতিমাধুর্য এ ভাষাকে উচ্চতর ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের ভাষার অঞ্চলবিশেষে স্বতন্ত্র মাত্রার পরিচিতি আছে। কুমিল্লার সঙ্গে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটের সঙ্গে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার বিস্তর পার্থক্য আছে। তার পরও সর্বনাম কিংবা ক্রিয়াপদের পরিবর্তনের ধরন প্রায় অভিন্ন। আঞ্চলিক ভাষা যা-ই হোক না কেন, আমরা সর্বজনের জন্য একটি মান ভাষা তৈরি করে নিয়েছি। এই মান ভাষার উচ্চারণ এবং লেখ্য রূপ বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত। সেই মান ভাষা রীতির মান রক্ষা করাই যেন কঠিন হয়ে পড়েছে।
আঞ্চলিক ভাষার বাঁচা-মরা
মান বাংলা আমাদের মাতৃভাষা নয়। আমাদের মাতৃভাষা আমাদের আঞ্চলিক ভাষা। কিন্তু জন্মের পর থেকে আমাদের অভিভাবকরা আঞ্চলিক ভাষা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখেন। জীবনের শুরু থেকে এমন একটি ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে, যাতে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা অনেকটা অশিক্ষিতসুলভ। অনেকেই এটাকে দূষণীয় জ্ঞান করে। ফলে দিনের পর দিন আমাদের আঞ্চলিক ভাষা ক্ষয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের আঞ্চলিক ভাষা আমাদের ভাষাবৈচিত্র্যের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষার প্রতি আমাদের যে অবহেলা তাতে আর কয়েক প্রজন্ম পরই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা মানুষ আছে কি না সন্দেহ।
আঞ্চলিক ভাষার যে গান সেই গানও আর নিখুঁত আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয় না। উদাহরণ হিসেবে রংপুরের ভাওয়াইয়া গানের কথাই বলি। আদি ভাওয়াইয়ার ভাষাকাঠামো আর নব্য ভাওয়াইয়ার ভাষাকাঠামো এক নয়। এক হওয়ার পথও প্রসারিত রাখা হয়নি। যিনি গান রচনা করছেন তিনি স্বয়ং যদি আঞ্চলিক ভাষায় অভ্যস্ত না হন, তাহলে তাঁকে দিয়ে আঞ্চলিক ভাষার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যেই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে সময় বয়ে চলছে, তাতে মনে হয় আঞ্চলিক ভাষার স্থান হবে জাদুঘরে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা
প্রতিবছর ভাষার মাস এলে ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা উপচে পড়ে। এর মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি সেই ভালোবাসা চরম প্রহসনমূলক ভালোবাসা সূচকের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে। ভাষার মাস শেষ তো ভালোবাসাও শেষ। যেন নাট্যমঞ্চে আমাদের ভাষাপ্রেমিকের ভূমিকার অভিনয় করা মাত্র। দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষায় স্নাতক সম্মান কোর্স চালু করা হবে। এমনকি সব বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তত একটি করে প্রায়োগিক ভাষা কোর্স পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্তকরণ বাধ্যতামূলক করা হবে। এসব শুধু বক্তব্যসর্বস্ব হিসেবেই আছে।
বাংলা না জানাটাই গর্বের!
আমি অনেক উচ্চশিক্ষিতকে গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছি, ‘আমি ভালো বাংলা পারি না। বানানের তো কিছুই জানি না।’ এক পৃষ্ঠা লিখলেই ভুল বানানে ভরা থাকে। বাংলা না জানাটা হতে পারত লজ্জার। তা না হয়ে হয়েছে গর্বের। সে কারণে আধুনিক শিক্ষিতরা বাংলা না জানাকে গর্বের বিষয় হিসেবে জ্ঞান করেন এবং বাংলাকে এড়িয়ে যান। এই বাস্তবতা এক দিনে তৈরি হয়নি। এর নেপথ্যে আমাদের অনেক রকম ব্যর্থতা আছে। সময় এসেছে সেসব ব্যর্থতা দূরীকরণের।
বাংলিশ প্রজন্ম
বর্তমান প্রজন্মের একটি অংশ মিশেলি ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করছে। তাদের ইশারাভঙিতেও বাঙালিয়ানা অনুপস্থিত। এই প্রজন্মের মধ্যে আমরা ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজন তুলে ধরতে পারিনি। বরং আন্তর্জাতিকতায় বাংলাকে অটুট রাখার বিশেষ ব্যবস্থাও আমাদের করা হয়নি। ইংরেজির প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব এবং বাংলার প্রতি উপেক্ষা বর্তমানে ভাষাকে মিশ্র ভাষায় পরিণত করেছে। এফএম রেডিওর কোনো কোনো সেন্টার সেই ভাষাচর্চার একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই রেডিও উপস্থাপকরা একটি স্বতন্ত্র উচ্চারণ রীতি আর শব্দ ব্যবহারে ভাষাকে ব্যবহার করছেন। মান বাংলা উচ্চারণরীতি—এই উচ্চারণরীতিতে অনুসরণ করা হয় না। সেই বিবেচনায় এ উচ্চারণরীতি বিকৃত।
কোন পথে বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষা কোন পথে হাঁটছে, তা নিয়ে গবেষণা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে আমাদের সামগ্রিক বাস্তবতা বাংলা ভাষার অনুকূলে নয়। প্রযুক্তি বাস্তবতায় ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রযুক্তিনির্ভর প্রচেষ্টা অপরিহার্য। কিন্তু ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভাষার গুরুত্ব সবার আগে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বাংলা ভাষার ওপর ভর করে কোনো জটিল বিষয়ে গভীরে যত সহজেই প্রবেশ করা সম্ভব হবে, অন্য কোনো ভিনদেশি ভাষার ওপর ভর করে তত সহজে জটিল বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না।
উচ্চারণ ও বানানরীতি সংকট
আমাদের লেখ্যরীতি এবং উচ্চারণরীতি এক নয়। আমরা যা লিখি, অনেক ক্ষেত্রে তা উচ্চারণ করি না। এর প্রধানতম কারণই হচ্ছে আমরা উচ্চারণরীতি নিয়েছি প্রাকৃত থেকে আর লেখ্যরীতি গ্রহণ করেছি সংস্কৃত থেকে। ফলে ‘পদ্মা’ লিখলেও উচ্চারণ করি ‘পদ্দা’। লেখ্য এবং উচ্চারণ যেকোনো একটি রীতির প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রে করা গেলেই শুধু এই জটিলতা দূর করা সম্ভব হতো।
ব্যক্তি-পরিবার-প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই বাংলা ভাষার প্রতি উপেক্ষা-অবহেলা চোখে পড়ার মতো। মেধা-মনন-চেতনানির্ভরতা আমাদের শিক্ষা দর্শনে খুবই সীমিত। ফলে আমাদের ভাষাগত সৌন্দর্য আমাদের আকৃষ্ট করে না। বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং বিস্তারে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। একটি ভাষাকে তার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিকাশের পথ মসৃণ হবে, রাষ্ট্রের কাছে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : ড. তুহিন ওয়াদুদ, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলো, ইউজিসি।