ভাষাসৈনিক ডা. এমএ হামিদ আর নেই - দৈনিকশিক্ষা

ভাষাসৈনিক ডা. এমএ হামিদ আর নেই

নেত্রকোনা প্রতিনিধি |

নেত্রকোনায় ভাষাসৈনিক ও বিশিষ্ট চিকিৎসক এমএ হামিদ খান (৮৯) মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। শনিবার রাত দেড়টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়।

ভাষাসৈনিক ডা. এমএ হামিদ | ছবি : সংগৃহীত

স্বজনরা জানান, রাতে শহরের সাতপাই এলাকায় নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি অসুস্থ অনুভব করেন। এর পর রাত দেড়টার দিকে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে নেত্রকোনা স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে তার গ্রামের বাড়ি পূর্বধলায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এমএ হামিদ খান ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ অক্টোবর নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি ইউনিয়নের মাথাং গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলী নেওয়াজ খান ও মাতা জাহেদা খাতুনের দুই ছেলেসন্তানের মধ্যে প্রথম তিনি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা আর ছয় বছর বয়সে মাকে হারাতে হয়েছে তার। পরিবারের অভিভাবক হন চাচাতো বড় ভাই আবদুল লতিফ। 

আবদুল লতিফের অনুপ্রেরণায় ভর্তি হন নিজ গ্রামের একটি মক্তবে। সেখানেই শুরু হয় তার হাতেখড়ি। পরে ভর্তি হন পাশের গ্রামের তেনুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে জেলা শহরের আঞ্জুমান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞান শাখায় দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। তার পর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তখনকার পূর্ববঙ্গের একমাত্র এই ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র তিনি। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করেন। তিনি নেত্রকোনা জেলার তৃতীয় এমবিবিএস চিকিৎসক।

এমএ হামিদ খান ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে নরসিংদী জেলার ঘোড়াশাল এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবক এএফএম সায়েদুল্লাহর মেয়ে লুৎফুরন্নাহার পারভীনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র ছেলে শামীম রেজা খান মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিন মেয়ে শামিমা নীলুফার রুবা, সিফা নুসরাত রুপো ও সারিকা নুজহাত রিমু উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। এদের মধ্যে সবার ছোট মেয়ে সারিকা নুজহাত রিমু বাবার মতো চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত।

বাল্যকাল থেকেই বইপড়া, কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, শিশু-কিশোর সংগঠন আর সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে বেশি পছন্দ করতেন তিনি।

মেডিকেলে অধ্যয়নকালে যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে মিছিলে সালাম, বরকত, রফিকরা ছিলেন সে মিছিলে অকুতোভয় এমএম হামিদও ছিলেন। ভাষাশহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় প্রথম যে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল রাতের আঁধারে তিনিও সেখানে শ্রম দেন।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ঢাকা থেকে নেত্রকোনায় প্রেরিত মেডিকেল টিমের নেতৃত্ব দেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত চিকিৎসক প্রিন্সিপাল মোফাখারুল ইসলামের মতো প্রতিথযশা চিকিৎসক।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন সারা দেশে কলেরা ও গুটি বসন্তের মতো রোগ ভয়াবহ এবং মহামারী আকার ধারণ করে, তখন তিনি নেত্রকোনায় চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য ‘ইমারজেন্সি হেলথ অফিসার’ হয়ে সেবা প্রদান করেন। রোগ নিমূল না হওয়া পর্যন্ত সেবা অব্যাহত রাখেন তিনি।

১৯৭১খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে তাদের পাশে থেকেছেন। কলেরা ও গুটি বসন্তের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে সেখান থেকেই তার উপলব্ধি জন্মে বঞ্চিত মানুষের পাশে নিজেকে সেবায় নিয়োজিত করা।

সে জন্যই সরকারি চাকরি, বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ও অবস্থান সব কিছুকেই উপেক্ষা করে তিনি নেত্রকোনার মানুষের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। রাজনীতির সঙ্গে কখনও যুক্ত না হলেও প্রগতিশীল বাম আদর্শ তিনি ধারণ করতেন। চিকিৎসার পাশাপাশি শিশু-কিশোর সংগঠন থেকে শুরু করে শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনেও তার অবদান সর্বজন স্বীকৃত।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে শহরের সাতপাই ফুটবল ক্লাবের সভাপতি, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন নেত্রকোনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে নেত্রকোনা ক্লাবের সহকারী সম্পাদক, ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ রেডক্রস ইউনিট নেত্রকোনা জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সুভয়েত মৈত্রী সমিতির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এ ছাড়া মুকুলের মহফিল, নেত্রকোনা ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি, জেলা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি, জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের সভাপতি, জেলা প্রেসক্লাব, রাইফেলস ক্লাব, সাধারণ গ্রন্থাগার, জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ, নেত্রকোনা সমাজকল্যাণ সমিতি, চক্ষু হাসপাতাল, নেত্রকোনা অন্ধকল্যাণ সমিতি, এন আকন্দ আলিয়া মাদ্রাসা, নেত্রকোনা টিচার্স টেনিং কলেজ, নেত্রকোনা শিশু বিদ্যালয়সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

এমএম হামিদ খান অসংখ্য পদক, সংবর্ধনা ও সম্মাননা লাভ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কলকাতার নেত্রকোনা সম্মিলনী তাকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে সংবর্ধনা দেন। নেত্রকোনা জেলা প্রেসক্লাব সম্মাননা, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ সম্মাননা, মানবাধিকার নাট্য পরিষদ সম্মাননা।

নেত্রকোনা শহরের সাতপাই কালীবাড়ি এলাকায় চিকিৎসক এমএ হামিদ খানের স্থায়ী নিবাস ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি মানবতাসেবা এবং সত্যের উপাসনায় নিয়েজিত ছিলেন।

সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048489570617676