আমাদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে। অনেক প্রবন্ধে এ বিষয়ে বিদৃত হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যেসব কথা বিভিন্ন প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাতে কেবল বড় বড় শহরের কথাই উঠে এসেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে কৃষক সমাজের মধ্যে ভাষা আন্দোলন যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এই বিষয়ে প্রায় কোথাও কেউ কিছু বলেননি। আমি নিজে ১৯৫২ সালে গ্রামের স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র। সে সময় এই ভাষা আন্দোলনের খবর গ্রামে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা স্কুলের সমস্ত ছাত্র ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম এবং আমাদের স্কুলের কাছাকাছি যে বাজার ছিল সে বাজারে হাঁটবার ছিল এই দিন। রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাজারের সামনে আমরা টিনের চুঙ্গা মুখে লাগিয়ে ( আমরা যতদূর পর্যন্ত জানি) ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে, মাতৃভাষার দাবি আদায় করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছে এসব কথা বলে চললাম এবং মানুষের কাছে তা তুলে ধরলাম। এবং যারা হাটে যাচ্ছে তাদেরকে উদ্ভুদ্ধ করতে থাকলাম যে, এই রকম যে ঘটনা ঘটছে এই জন্য সবারই প্রতিবাদ জানানো উচিত। এই প্রতিবাদের একটা মাধ্যম হিসেবে আমরা বলেছি যে, হাটে আজকে হরতাল হবে। এই হরতালের কথা শুনেই সকলেই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা কেউ আর হাটে যাব না। নেত্রকোনার গ্রামের ভাষায় তারা বলতে শুরু করল এবং অনেকেই কাঁদতে লাগল। আমরা আমরার পুলাপানরে শহরে পাঠাই লেখাপড়া শিখনের লাই আর সেখানে গিয়া গুলি খাইয়া মরব এই অবস্থা যদি চলে তাইলে শুনতেছি তারা নাকি ভোট চাইতে আসব। ভোট নাকি অইব তাই ভোট চাইতে গেলে ভোটের বদলে ঝাডা মারা লাগবো। আজকে আপনারা কেউ হাটে বাজারে যাবেন না। আইজের জন্য আমরা হরতাল করলাম। এইভাবে দেখা গেল স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই হাটে হরতাল হয়ে গেল এবং এইভাবে আমরা বেশ কয়েকটি হাটে কয়েক দিন হরতাল পালন করলাম এবং সব হরতালের জন্য সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিল।
এই বেপারটি যে গ্রামাঞ্চলে ঘটেছিল তা নিয়ে কি কোনো বই পত্র আছে? যদি গ্রামাঞ্চলে সাধারণ কৃষকের মধ্যে তাদের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে যদি মাতৃভাষার ধারণা সৃষ্টি করা না হতো, ভাষা আন্দোলনে তারা যদি এইভাবে যুক্ত না হতো, তাহলে কয়েকটি বড়বড় শহরের ভাষা আন্দোলন দ্বারা আমরা আজ যতটুকু পেয়েছি তার কিছুই পেতাম না। আমি তো সেই সময়ে ’৫২ সালে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আমার এক অগ্রজপ্রতিম বন্ধুকে খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম অর্থাত্ হাকিম ভাইকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অনেক বাড়িতে গিয়ে উঠান বৈঠক করেছি। সেই উঠান বৈঠকের মধ্যে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আমাদের কী করতে হবে, কীভাবে আমাদের ভাষাকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এই কথাগুলো আমরা বলেছি এবং সকলেই আমাদের কথায় সায় দিয়েছে এবং সেই সময় বলেছে, ‘ইলেকশান নাকি হবে? সেই ইলেকশানে আমরা দেখায়ে দেব।’ এই অবস্থা সেদিন হয়েছিল। শুনলাম, একটা মাদ্রাসায় নাকি কয়েক জন শিক্ষক উর্দু ভাষার পক্ষে মিছিল বের করবেন এই কথা শুনে হাকিম ভাই বললেন, এদের সবাইকে মাথা ভেঙে দিতে হবে। মিছিল কী করে বের করে, আমরা দেখে নেব। অবশ্য কারো মাথা ভাঙার প্রয়োজন পড়েনি। শেষ পর্যন্ত মিছিল বের করার আর সাহসই পায়নি। এভাবে ভাষা আন্দোলন যে সমস্ত গ্রামগঞ্জে বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল, সে জিনিসগুলো বিস্তারিতভাবে বইপত্রে আসার দরকার। সেই সঙ্গে আসা দরকার ভাষা আন্দোলনের ফল আমরা পেয়েছি কি না আর কীভাবে পেয়েছি সেই ব্যাখ্যা। আমরা বলি ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে ধারণ করেই আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য যে প্রয়াস নিয়েছি রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করার যে অপপ্রয়াস চলছিল তা আমরা বাতিল করেছি, নজরুলকে খণ্ডিত করার যে অপপ্রয়াস চলছিল তা বাতিল করেছি, আরো আরো কাজ করেছি। অথচ আমরা কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মাতৃভাষাকে যথাযথভাবে আমাদের
জীবনের সর্বত্রই ব্যবহার করার মতো স্বাধীনতা পেয়েও আমরা কোনো গরজ করেছি বলে মনে হয় না। বরং এখন দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু পয়সাওয়ালা লোক তারা নিজেদের ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করে এবং ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে ভর্তি করেই তারা নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করে এবং যে ভাষা তারা বলে সে ভাষা না বাংলা, না ইংরেজি। ইংরেজি স্কুলের মাধ্যমে পড়ে তারা বাংলাও শেখে না ইংরেজিও শিখে না। ভাষা আন্দোলনের যে প্রাপ্তি ছিল তা হতে পারত স্বার্থক। কিন্তু এইভাবে আমরা অপ্রাপ্তিতে চলে গিয়েই আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছি।
সেগুলো আমাদের ভালো করে বোঝা দরকার আর সত্যিকার অর্থে, কথা হচ্ছে, অফিস-আদালত থেকে আরম্ভ করে কোনোখানেই মাতৃভাষা বাংলার প্রকৃত ব্যবহার হচ্ছে না। সেই ব্যবহারটা যাতে হয়। একেবারে উচ্চ আদালত থেকে সাধারণ অফিস-আদালত পর্যন্ত বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে শুধু বাংলা ভাষার ব্যবহার নয়, আমাদের ইংরেজিও রপ্ত করতে হবে। আমাদের অনেক ভাষা শিখতে হবে। বিশেষ করে, ইংরেজি ভাষা থেকে আমরা অনেক জিনিস আমাদের বাংলা ভাষায় নিয়ে আসতে পারলে অনেককিছু্ই সহজ হয়ে উঠবে। ইংরেজি ভাষাটাকে আমরা ভালো করে শিখব কিন্তু সেই ইংরেজি থেকে আমরা যাতে ভালো করে বাংলা করতে পারি, মানুষের কাছে সেগুলো পৌঁছে দিতে পারি সেটা করতে হবে। আবার বাংলা থেকে আমাদের সাহিত্যের আমাদের সংস্কৃতির বিষয়গুলোকে ইংরেজিতে যথাযথভাবে অনুবাদ করে বিদেশে পৌঁছে দিতে হবে। এজন্যই বলি ইংরেজি ভাষাটাও আমাদের ভালো করে শিখা উচিত। সম্ভব হলে অন্যান্য ভাষাও শিখা উচিত। এইভাবে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে আমাদের বাংলা ভাষার উন্নতি সাধন করতে পারি এবং বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারি। মোটামোটিভাবে ভাষা আন্দোলনের মাসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : যতীন সরকার, প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী।